ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সোয়াইন ফ্লু ॥ নতুন আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

সোয়াইন ফ্লু ॥ নতুন আতঙ্ক

ভারতে কয়েক মাস ধরে চলছে সোয়াইন ফ্লুর মহামারী। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে, রাজস্থানে এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় প্রায় ১৫ হাজার, যার মধ্যে মারা গেছে প্রায় ১০০ জন। ২০১৬ সালেও ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে ১৩৭০ জন। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশেও রোগটি দ্রুত ছড়াতে পারে। তবে সতর্ক থাকলে বিপন্মুক্ত থাকা সম্ভব। ২০০৯ সালে ভাইরাসটি ছিল এইচ-১ এন-১ গোত্রের। উত্তর আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীব্যপী সতর্কতা জারি করে। পরে ২০১১ সালে এইচ৩ এন২ ভাইরাস নামের আরেকটি গোত্রও সংক্রমিত হয়েছিল। সোয়াইন ফ্লু শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এটি মূলত শূকরের মাঝেই পাওয়া যায়, তাই তাকে ‘সোয়াইন ফ্লু’ ভাইরাস বলে। এটি সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা, হগ ফ্লু, পিগ ফ্লু বা মেক্সিকান ফ্লু ইত্যাদি নামেও পরিচিত। সোয়াইন ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো একটি ভাইরাস দিয়ে হয়। যার আসল নাম এইচ-১ এন-১ ভাইরাস। প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাসটি শূকরকে আক্রান্ত করে। তবে মানুষকেও সংক্রমিত করতে পারে। ২০০৯ সালে প্রথম সংক্রমণটি ধরা পড়ে মেক্সিকোতে। এরপর পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির সংক্রমণে ফুসফুসে নিউমোনিয়া হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। কিভাবে ছড়ায় : ভাইরাস আক্রান্ত শূকরের সংস্পর্শে কোন মানুষ এলে তাঁর মধ্যে শ্বাসের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়ায়। শূকরের ফার্মে কর্মরত ব্যক্তিদের এভাবেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে সহজেই এর জীবাণু অন্যজনের দেহে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ ভাইরাস বাতাসে ছড়ায়। নিত্য ব্যবহার্য বস্তু যেমন রিমোট কন্ট্রোল, এ টি এম বুথের বোতাম, দরজার হাতল বা কম্পিউটারের কি বোর্ডের ওপর এই ভাইরাস লেগে থাকে। কোন সুস্থ ব্যক্তি ঐ বস্তুর সংস্পর্শে এলে এই রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত শূকরের রান্না করা মাংস খেলে এই রোগ হয় না, তবে অর্ধসিদ্ধ বা কাঁচা খেলে হতে পারে। লক্ষণসমূহ : ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের এক থেকে চারদিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। লক্ষণ থাকে এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। ক্স ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে যে ধরনের লক্ষণ থাকে, সোয়াইন ফ্লুতেও একই ধরনের লক্ষণ থাকে। তাই আক্রান্ত হলে সহজেই বোঝা যায় না, রোগটি আসলে সাধারণ সর্দি-কাশি নাকি সোয়াইন ফ্লু। ক্স সাধারণত ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি জ্বর হয়। কাশি, এর সঙ্গে নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, শরীর দুর্বল বোধ হয়, মাথাব্যথা থাকে। কারো কারো গলাব্যথা হয়, শরীরে র‌্যাশ ওঠে, কাঁপুনি হয় ও বমি বমি ভাব হয়, পাতলা পায়খানাও হতে পারে। ক্স কোন কোন রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্টও দেখা যায়। অনেক সময় ভয়াবহ শ্বাসকষ্টে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসেরও প্রয়োজন হতে পারে। ক্স কারো কারো আবার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ যেমন নিউমোনিয়া হতে পারে, যা সেকেন্ডারি ইনফেকশন নামে পরিচিত। মূলত সোয়াইন ফ্লুতে মৃত্যু ঘটে এই সেকেন্ডারি ইনফেকশন থেকে। উপযুক্ত এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে তা অনেকখানি প্রতিরোধ করা যায়। ক্স যাদের আগে থেকেই রোগপ্রতিরোধ ঘাটতিজনিত সমস্যা (যেমন ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কেমোথেরাপি পাচ্ছে এমন রোগী, শিশু, বয়স্ক) আছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তের ছয় শতাংশের কম রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বর্তমানে এ হার আরও কমেছে। রোগ নির্ণয় : রোগীর লক্ষণ ও ইতিহাস থেকে প্রাথমিকভাবে রোগটি সম্পর্কে ধারণা করা হয়। রোগীর নাকের পানি বা মুখের লালা থেকে সোয়াব নিয়ে পিসি আর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে এইচ-১ এন-১ শনাক্ত করা যায়। চিকিৎসা : এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভাল হয়ে যায়। ক্স সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তদের প্রাথমিকভাবে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। যেমন জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, সর্দির জন্য এ্যান্টিহিস্টামিন। তবে নিউমোনিয়া সন্দেহ হলে উপযুক্ত এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়। শ্বাসকষ্টের জন্য সালবিউটামল, প্রয়োজনে অক্সিজেনও দিতে হয়। ক্স জানামিভির ও ওসেল্টামিভির নামের দুটি এন্টিভাইরাল ওষুধ সোয়াইন ফ্লুতে ভাল কাজ করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ দুটো ওষুধই ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ও বি ঘটিত অসুখের লক্ষণ কমাতে কাজ করে। লক্ষণ প্রকাশের আগে বা প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এগুলো সেবন করলে সোয়াইন ফ্লু ঘটিত জটিলতা অনেকটা এড়ানো যায়। ঝুঁকিপূর্ণ রোগী বা রোগ সন্দেহ হলেই এন্টিভাইরাল ব্যবহার করা উচিত। * এছাড়া পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে, স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। * অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট বা কাশি হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, এমনকি অবস্থা জটিল হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হবে। সোয়াইন ফ্লুর ঝুঁকি : মেক্সিকোতে প্রথম যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল কম। দেখা গেছে, সোয়াইন ফ্লুতে অল্প বয়সীরাই বেশি আক্রান্ত হয়। তবে বেশি বয়সীরা আক্রান্ত হলে তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি থাকে : * ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা এবং বয়স্করা। * শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক যাদের আগে থেকেই ফুসফুসঘটিত রোগ, যেমন এ্যাজমা, হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ, লিভারের অসুখ, রক্তের অসুখ, স্নায়ুর অসুখ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি আছে। * যাদের ইমিউনোসাপ্রেসিভ অসুখ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি আছে। * গর্ভবতী মা। * হাসপাতালের ডাক্তার নার্সসহ কর্মীরা ও রোগীর কাছে থাকা আত্মীয়-স্বজন। * যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (বিএমআই ৪০ বা তার বেশি) রোগ প্রতিরোধে যা করতে হবে : এই রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা ভাল। এ জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন বা টিকা নেয়া যেতে পারে। এমনকি এইচ-১ এন-১ ভ্যাকসিনও বাজারে এসেছে ২০০৯ সাল থেকে। আরেকটি নতুন ভ্যাকসিন (ট্রাইভ্যালেন্ট) আমেরিকার বাজারে পাওয়া যায়। * খাবারের আগে প্রত্যেকের উচিত সাবান দিয়ে ভাল করে হাতমুখ ধোয়া। নিয়মিত পরিধেয় কাপড় ধৌত করা ও গোসল করা। * বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখে হাত না দেয়া। * ছোট শিশুদের কোলে নেয়ার আগে হাত সেনিটাইজার বা এ্যান্টিসেপটিক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নেয়া। * সম্ভব হলে দরজা বা চেয়ারের হাতল, ফোন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের কিবোর্ডের মতো ব্যবহার্য সামগ্রী সেনিটাইজার বা এন্টিসেপটিক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা। * বাড়ির বা অফিসের আসবাবপত্রের উপরিভাগ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখা। * ভিড় এড়িয়ে চলুন। রোগাক্রান্ত এবং হাঁচি কাশিতে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজনে মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে চলাচল করুন। ব্যবহৃত মাস্ক আর ব্যবহার না করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দেয়া। * রোগীর হাঁচি কাশি বা জ্বর থাকলে রুমাল ও মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। * সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত রোগী থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত দূরত্ব বজায় রাখুন। আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে একই পাত্রে খাবেন না, পরিধেয় বস্ত্র ব্যবহার করবেন না। * কফ ও শ্লেষ পরিষ্কার করার জন্য টিস্যু পেপার ব্যবহার করা এবং ব্যবহারের পরে নিরাপদ স্থানে ফেলুন। * আক্রান্ত হলে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করুন। * আক্রান্ত হলে স্কুল, কলেজ অথবা কর্মস্থলে না গিয়ে বাড়িতে, অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন, যাতে অন্যরা আক্রান্ত না হয়। সতর্কতা জরুরী : সোয়াইন ফ্লুর জীবাণু খুব সহজেই ছড়াতে পারে। তাই সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর, নৌবন্দর ও বিমানবন্দরে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জ্বর-সর্দি-কাশি থাকলে তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করা উচিত। সোয়াইন ফ্লু আবার বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ফ্লুর মতোও। তাই কারো যদি সোয়াইন ফ্লু সন্দেহ হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে রোগটির পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসাও আছে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকাটাই বেশি জরুরী। লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×