ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ডিজিটাল জালিয়াতি ॥ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ডিজিটাল জালিয়াতি ॥ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ উচ্চ প্রযুক্তির প্রক্রিয়ায় জালিয়াত চক্রের ছোবলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান। চট্টগ্রাম কাস্টমসের ইতিহাসে এ ঘটনাকে ডিজিটাল জালিয়াতি হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত অর্থবছরে। যে কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ওই অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরে ছয়মাসে রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যের খালাস প্রক্রিয়ায় বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির এ ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতটি সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত বলে প্রাথমিক তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জালিয়াতচক্র জড়িত। সম্প্রতি এ জালিয়াতির ঘটনা প্রাথমিকভাবে উদ্ঘাটিত হওয়ার পর এক সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিককে আটক করা হয়েছে। ঢাকার রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত কাজ মঙ্গলবার ঢাকার সিআইডির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ঢাকা সিআইডির পুলিশ সুপার মাহমুদ হোসেনের ওপর এর তদন্তভার ন্যস্ত হয়েছে। অপরদিকে, ইতোমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি করে তদন্ত শুরু করেছে। এ ঘটনার কারণে সোমবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামানকে প্রত্যাহার করে শুল্ক মূল্যায়ন ও ঢাকা অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের কমিশনার পদে পদায়ন করা হয়েছে বলে চাউর হয়েছে। যদিও রাজস্ব বোর্ড থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। এছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে নতুন কমিশনারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমানকে। গত সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আরও কয়েক কমিশনারেটের কমিশনার পদে রদবদল আনা হয়েছে। ঘটনার বিবরণ দিয়ে কাস্টম সূত্রে জানানো হয়, ২০১৬ সালের শেষদিকে ডিজিটাল জালিয়াতির এ ঘটনা শুরু হয়, যা চলতি অর্থবছরের বর্তমান জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় যে দু’জন রাজস্ব কর্মকর্তার পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করা হয়েছে তাদের একজন বর্তমানে অবসরে চলে গেছেন। আরেকজন ঢাকা ভ্যাট কমিশনারেটে এখন কর্মরত রয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে এই দুই রাজস্ব কর্মকর্তার আইটি পাসওয়ার্ড হ্যাক করে এ জালিয়াতির ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। এদের একজনের পাসওয়ার্ড ৩৬৮৬ ও আরেকজনের ১১৬ বার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে সুনির্দিষ্টভাবে ২১টি চালান চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যেখানে শুল্কও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, গোপন সূত্রের খবরের ভিত্তিতে এ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. শহিদুল ইসলাম তার কয়েক কর্মকর্তাকে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। অনুসন্ধানে একের পর এক ডিজিটাল জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসছে। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে তোলপাড় চলছে। সূত্র জানিয়েছে, ২৫ ও ১৫ শতাংশের শুল্কের আমদানির বিপুল পরিমাণ পণ্য শুল্ক জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস হয়ে গেছে। যে কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে শূন্য শুল্কের পণ্যের পরিমাণ বেড়েছে এবং রাজস্ব কমেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ইতিহাসে যে কারণে বর্তমান অর্থবছরের ছয় মাসে ধস নামার ঘটনা উঠে এসেছে। জালিয়াতির কারণে আমদানি পণ্যের ভলিউম বেড়েছে, কিন্তু শুল্কহার যে কমেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাস্টম হাউসের মনিটরিং ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে পণ্য বন্দরে রয়েছে। অথচ, এ পণ্য বাস্তবে জেটির কোথাও নেই। অর্থাৎ, জালিয়াত চক্র অতি কৌশলে খালাস করে নিয়ে গেছে। সূত্র জানায়, এ বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর হয়েছে যে, একজন রাজস্ব কর্মকর্তা ও আরেকজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে এ পর্যন্ত যে ৭টি সিএ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে এম. আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, চাকলাদার সার্ভিস, স্মরণিকা শিপিং, কাইজেন লিঃ, মজুমদার ইন্টারন্যাশনাল, লাবণী এন্টারপ্রাইজ লিঃ, মেসার্স লায়লা ট্রেডিং কোম্পানি ও এ্যান্ড কে ট্রেডিং কর্পোরেশন। এই সাত সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের মধ্যে প্রথম দুটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ঢাকার রমনা থানায় মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। মামলার পর এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিজানুর রহমান শুল্ক জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাস করে নেয়ার কিছু তথ্য দিয়েছে। ঘটনাটি এতই স্পর্শকাতর হয়েছে যে, অধিকতর তদন্তের জন্য তা মঙ্গলবার সিআইডির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ত্রিমুখী তদন্ত সমান্তরালভাবে চালানোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
×