ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বেহাল অর্থনীতি ॥ চ্যালেঞ্জের মুখে ইমরান খান

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

বেহাল অর্থনীতি ॥ চ্যালেঞ্জের মুখে ইমরান খান

পাকিস্তানীদের মনে অনেক আশা-প্রত্যাশার জন্ম দিয়ে গত জুলাইয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি বুঝতে পারলেন জনগণের জন্য ভাল কিছু করতে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। তার পরও প্রত্যাশা পূরণ করা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সন্দেহ থাকার কারণ দেশটির অর্থনীতি ভাল নয়। এক বছর আগে অর্থনীতির যেখানে বছরে ৫.৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল সেখানে আজ তা দারুণ মন্থর হয়ে পড়েছে। খাদ্য, বিদ্যুত ও সুপেয় পানির দাম বেড়ে গেছে। করাচীর কারখানা শ্রমিকরা বলছে মাসে ২২ হাজার রুপী (১৬০ ডলার) আয়ে কোনভাবে কায়ক্লেশে চলা সম্ভব। তাদের জন্য জীবন বরাবরই কঠিন ছিল। আজ আরও বেশি কঠিন। দক্ষ শ্রমিকদের জন্য ভাল চাকরি পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও অতি দুর্বল। বিদ্যুত ও পানির ক্রমবর্ধমান দাম মিল মালিক থেকে শ্রমিক পর্যন্ত সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দাবি করা আজ প্রায় প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে। এক চাল রফতানিকারক জানিয়েছেন তার ব্যবসা চালানোর জন্য সিভিল ডিফেন্স থেকে স্থাস্থ্য দফতর পর্যন্ত ১৪ জায়গায় ঘুষ দিতে হয়। পাকিস্তানের চিরাচরিত রাজনৈতিক ক্লানগুলোর স্বজনপ্রীতি এবং ঘুষ-দর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদে ঘোষণা করেই ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন ইমরান খান। নেপথ্যে সেনাবাহিনীও তার উত্থানে সাহায্য করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। সেটা হলো দায় পরিশোধ বা লেনদেনে ঘাটতির সঙ্কট। এই সঙ্কটের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো চীনের প্রভাব। চীনের ৬ হাজার কোটি ডলারের ঋণ ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির পেক্ষাপটে বেশ কিছু প্রকল্পের, বিশেষ করে অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ চলছে। অর্থের ঢল নামায় অভ্যন্তরীনণ চাহিদা বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি। ২০১৫ সালে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল জিডিপির ১ শতাংশ। ২০১৮ সালেই তা স্ফীত হয়ে ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দারুণ কমে আসে। ফলে আগে সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ জোরেশোরে চলছিল তা বেশ মন্থর হয়ে পড়ে। এতে করে প্রতিবেশীদের তুলনায় পিছিয়েই পড়ে থাকে পাকিস্থান। দেশটির মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হারও বাড়ছে। ইমরান প্রথমে সদম্ভে বলেছিলেন তিনি আইএমএফকে থোরাই পরোয়া করেন। তিনি পাকিস্তানের সর্বকালে বন্ধু সৌদি আরব ও চীনের দ্বারস্থ হন। খাশোগি সঙ্কটের কারণে সৌদি আরব তার চেক বই খুলতে সময় লাগায়। শেষে ৬শ’ কোটি ডলারের ঋণ এবং তেলের দাম বিলম্বে পরিশোধের সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমিরাতও মোটামুটি একই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইমরান নবেম্বর মাসে চীন সফরে যান। কিন্তু তিনি তার প্রত্যাশিত আর্থিক সাহায্যের কোন রকম সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি চীনের কাছ থেকে পাননি। অগত্যা দেশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধারের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকেনি ইমরানের। তিনি আশা করছেন আইএমএফের কাছ থেকে ১২শ’ কোটি ডলার পাবেন। আইএমএফই বা ছেড়ে দেবে কেন! তারা শর্ত দিয়েছে। বলেছে এর বিনিময়ে জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে এবং রফতানি খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি যত তাড়াতাড়ি হবে বলে সরকার ধারণা করেছিল তা হয়নি। তবে বছরের প্রথমদিকেই হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের নয়া অর্থমন্ত্রী আসাদ ওমর আশা করছেন যে সৌদি আরব ও আমিরাত থেকে যে অর্থপ্রাপ্তি ঘটবে তা দিয়ে আগামী বছর নগদ অর্থের ঘাটতি সঙ্কট মিটবে। আইএমএফের ঋণ ফেলে তা দিয়ে আরও দুই বছর চলবে। এর পর আছে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী। জনাব উমর এক সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করার আশা করছেন। তবে তিনটি বছরকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কর খাত থেকে এই রাষ্ট্রের প্রাপ্তি যৎসামান্যÑ জিডিপির মাত্র সাড়ে ১০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার বর্ধিষ্ণু কালোবাজারের বদৌলতে অসৎ পথে অর্জিত অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কাজেই কর ফাঁকির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো জরুরী হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো পাকিস্তানের অবরুদ্ধ রফতানিকারকদের সাহায্য করা। তবে সে কাজটা বিশাল। গত চার দশকে পাকিস্তানের রফতানি ভারতও বাংলাদেশের তুলনায় মাত্র এক-পঞ্চমাংশ দ্রুত হারে বেড়েছে। তৃতীয়ত উমর রাষ্ট্রীয় খাতকে ঢেলে সাজাতে চান। রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে মন্ত্রী ও আমলাদের আওতা থেকে নিয়ে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হোল্ডিং কোম্পানিতে পরিণত করা হবে। ফলে লুটপাট ও অপশাসনের লোভনীয় টার্গেট এগুলো আর হতে পারবে না। তবে কথা হচ্ছে বাইরে থেকে টাকা পয়সা ধার করে এনে বিপুল পরিমাণ আমদানি অব্যাহত রাখা এক ঐন্দ্রজালিক ভাবনা। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধি না করে বাইরে থেকে কখনই সাফল্য কিনে আনা যায় না। ওদিকে চীনÑপাকিস্তান অর্থনৈতিক সহযোগিতার কারণে পাকিস্তানের রূপী অতি মূল্যায়িত থাকছে এবং বিশ্ববাজারে পাকিস্তানের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ওই সহযোগিতার আওতায় চীনা সাহায্যের কারণে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ অর্ধেক বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে যা জিডিপির ৩২ শতাংশ। চীনা সহযোগিতা বা সাহায্যের ওপর যে কোন বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আছে। তেমনি আছে এই সংক্রান্ত যে কোন সমালোচনা। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা। আবার এই জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে। সেনাবাহিনী। বিনিয়োগ অর্থবহ হতে পারে তখনই যখন অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়। আর সেই গতি সঞ্চার প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারের মাধ্যমেই কেবল হতে পারে। অথচ সেই বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করাই হলো জেনারেলদের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে এই উদ্ভট ধরনের আচ্ছন্নতর জন্যই দেশটির অর্থনৈতিক সমস্যার অর্থনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া রীতিমতোই কঠিন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×