ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শায়িত হলেন

শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত বুলবুল

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত বুলবুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভক্ত অনুরাগীদের শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বুধবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সুরকার, গীতিকবি ও সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে বাদ আসর সমাহিত করা হয় এই শিল্পীকে। এর আগে সকালে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের জন্য বুলবুলের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। এ সময় জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছিল তার কফিন। বীর এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। বিউগলে তখন বাজতে থাকে করুণ সুর। ২ নম্বর সেক্টরে সজীব গ্রুপের সদস্য ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গ্রুপের জীবিত সদস্যরা এদিন সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রিয় বন্ধুর প্রতি সামরিক কায়দায় সেলুট প্রদান করেন তারা। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ রাখা হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সহকারী সামরিক সচিব ইফতেখারুল আলম। পরে প্রয়াত বন্ধুর কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান একাত্তরের সহযোদ্ধারা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পুরোটা সময় বাজতে থাকে বুলবুলের অসামান্য সুরÑ সব কটা জানালা খুলে দাও না...। গানটি নতুন করে আবেগে ভাসায়। ভারাক্রান্ত করে তুলে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শ্রদ্ধা জানায় ওয়ার্কার্স পার্টি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, গণসংহতি আন্দোলন। উদীচীর পক্ষ থেকে ফুল দেয়া হয়। শ্রদ্ধা জানায় জাতীয় কবিতা পরিষদ, চারুশিল্পী সংসদ, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পরিষদ, ¯্রােত আবৃত্তি সংসদ, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাসাস ও এলআরবি। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বুলবুলের মরদেহের পাশে ছিলেন তার ছেলে সামির ইমতিয়াজ মুন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের দুই বোন রোকসানা তানজিম মুকুল ও রোয়েনা হাসান মিতুল। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, তার চলে যাওয়া এ দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য বড় ক্ষতি। তার সব সৃষ্টিকর্ম সরকার সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হবে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, তার মৃত্যুতে শুধু দেশের সঙ্গীতাঙ্গন নয়, সমগ্র জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তার সৃজনকর্ম সংরক্ষণের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেয়া দরকার, তা করা হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, তিনি শুধু গানের জন্য নয়, দেশের প্রতি যে অবিস্মরণীয় ভালবাসা দেখিয়েছেন তা ভোলার নয়। ২০১২ সালে গঠিত মানবতাবিরোধী অপারাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য দেন তিনি। যার কারণে পরবর্তী সময়ে তার ভাই প্রাণ হারান। গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন-এই ত্রয়ীর কালজয়ী সৃষ্টি ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’ গানটি তো এখন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রয়াত শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই গানের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো বাঙালীর স্বাধীনতা নিয়ে গানের প্রতি বেশি দুর্বলতা ছিল বুলবুলের। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার দেশাত্ববোধক গানগুলো আর দশটা গানের চেয়ে আলাদা। ওনাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। এমন প্রতিভা আর আসবে বলে মনে হয় না। তার প্রয়াণে যে ক্ষতি হলো, তার শূন্যস্থান কখনই পূরণ হওয়ার নয়। বুলবুলের মতো মিউজিক ডিরেক্টর কখনও আসেওনি; ভবিষ্যতেও আসবে কি না জানি না। শ্রদ্ধা জানাতে এসে আরেক মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের বিশ্বাস আর চেতনা থেকে কখনোই সরে যাননি বুলবুল। এমনকি তার সব কাজে-কর্মে সেই আদর্শ প্রতিফলিত হতো। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, আমরা একজন পরিপূর্ণ মানুষকে হারালাম। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে সে চলে গেল। এত অল্প বসয়ে তার লাশ বহন করতে হবে তা ভাবিনি। এই দুঃখ অনেক দিন আমাকে স্মৃতিগ্রস্ত করে রাখবে। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে সামিনা চৌধুরী বললেন, তার মুখের দিকে তাকালে এখন মনে হচ্ছে, কী পবিত্র একটি মুখ। এখনই বুঝি বলে উঠবেন ‘ওই সুরটা গাও’। তার চলে যাওয়ায় আমরা একটি ছায়া হারালাম। বুলবুল ভাইয়ের দেয়ার অনেক কিছু বাকি ছিল। মানুষ হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, তা আমরা সবাই জানি। তিনি আমাদের যা দিয়ে গেছেন, তা আমরা সবাই চর্চা করে যাব। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন, স্পন্দন ব্যান্ডে বাজাত সে। আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন বাজিয়েছে। আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তিনিও থাকবেন। সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেন, সঙ্গীত সম্পর্কে আধুনিক চিন্তা ভাবনা ছিল তার। স্বাধীনতার পরে নতুন সঙ্গীত চিন্তা নিয়ে যারা কাজ শুরু করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তাদের অন্যতম। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে সার্বক্ষণিক ছিলেন শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। বুলবুলের সুরে অনেক গান গেয়েছেন তিনি। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষটিকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ধরে আসছিল তার। বললেন, আমরা সঙ্গীতের এক মহাজনকে হারিয়েছি। জানি না এই ক্ষতি আমাদের কোন জনমে গিয়ে পূরণ হবে। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন, বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় ছেলে সামির আহমেদ বললেন, এই শ্রদ্ধা বাবার প্রাপ্য ছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যা করা প্রয়োজন, তিনি তার সেই কাজ করে গেছেন। বাকিটা মানুষ করবে। আমাদের পরিবারের দাবি ছিল- মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের। প্রধানমন্ত্রী যে দাবি পূরণ করেছেন, এর জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। শহীদ মিনার থেকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে বাদ আসর তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর এফডিসি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। তাতে অংশ নেন চিত্রনায়ক আলমগীর, রিয়াজ, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান প্রমুখ। এরপর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারতি স্থানে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে সমাহিত করা হয়।
×