ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে

মোবাইল টাওয়ার পুরোপুরি সরেনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

মোবাইল টাওয়ার পুরোপুরি সরেনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ লোকালয় ও বাসা বাড়ির ছাদ থেকে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর টাওয়ার সরানোর কাজ পুরোপুরি এগোয়নি। এতে করে মানুষ ও অন্যান্য পশু পাখির স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা। বিটিআরসির ভাষ্য মোতাবেক মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব টাওয়ার লোকালয় ও বাসা বাড়ির ছাদ থেকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় স্থাপন করতে হবে। একটি টাওয়ার থেকে সব মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক মেনটেন করতে হবে। আর পুলিশ বলছে, একজন গ্রাহকের বিপরীতে সীমিত সংখ্যক সিমকার্ড ইস্যু করতে হবে। বেশি হারে সিমকার্ড ইস্যু করার কারণে মনিটরিং করা কঠিন। অনেক সময়ই বেনামি সিমকার্ড অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হচ্ছে। তা কঠোর হস্তে রোধ করতে হবে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এসব নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যদিও ফোন কোম্পানিগুলো কাজ দ্রুত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে। সম্প্রতি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে পুলিশের কাছে বলা হয়েছে, তাদের দামী দামী ব্যাটারি চুরি হয়ে যাচ্ছে। চোরদের সিন্ডিকেট ধরতে না পারার কারণে তাদের ব্যবসায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে এবং নেটওয়ার্কিং কর্মকা-ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো বলছে, দেশে ছয় মোবাইল ফোন অপারেটর আছে। যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দশ কোটি। এসব মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সচল রাখার জন্য সারাদেশে সবমিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি বেস টাওয়ার কার্যকর আছে। গ্রামে ধানক্ষেত, পরিত্যক্ত উঁচুজমি, রাস্তার পাশে বন্যামুক্ত স্থানে আর শহরে বসানো হচ্ছে বিভিন্ন বাসা বাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবনের ছাদে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গড়ে ওঠা কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে এমনকি হাসপাতালের ছাদেও মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার আছে। এসব টাওয়ার থেকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে বিটিআরসি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে তাদের টাওয়ার যথাসম্ভব নিরাপদ জায়গায় স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দেয়। এজন্য চার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয় বিটিআরসি। এ সংক্রান্ত আইনও সংশোধন করেছে বিটিআরসি। আইন মোতাবেক যেখানে সেখানে থাকা মোবাইল ফোনের টাওয়ার সরিয়ে ফেলতে হবে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি টাওয়ার বসবে। সেই টাওয়ার থেকেই সব মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে হবে। উচ্চ আদালত আইনজীবী মনজিল মোর্শেদের এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে মোবাইল টাওয়ারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেয়। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন পরীক্ষা করে। তাতে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বের হওয়ার তথ্য মিলে। শুধু টাওয়ার নয়, মোবাইল ফোন থেকেও রেডিয়েশন বের হয়। যার সরাসরি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন ও ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজক্রিয় রশ্মির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মোবাইল ফোন ও ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজক্রিয়তা শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। শিশুদের চোখ ও ব্রেন মারাত্মক ক্ষতি করে। আর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হিসেবে মানবদেহে ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, অল্প সময়ের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। শুধু মানবদেহ নয়, পশুপাখি ও গাছপালারও ক্ষতি হয়। এজন্য মোবাইল ফোন যত্রতত্র ব্যবহার না করাই ভাল। অনেকেই অহেতুক মোবাইল ফোন চালান। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর মোবাইল ফোন কান থেকে যতটা সম্ভব দূরে রেখে ব্যবহার করলে কান ও ব্রেনের জন্য ভাল। দিনের বেলা না হলেও রাতের বেলায় মোবাইল ফোনের ব্যাক লাইট বা উজ্জ্বলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা ভাল। তাতে চোখের জন্য ক্ষতি কিছুটা কম হবে। সম্প্রতি ভারতে মোবাইল টাওয়ারের ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। তাতে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের রেডিয়েশনের কারণে চড়ুই, মৌমাছি, ব্যাঙ, বাঁদুর, চামচিকা, শালিক, টুনটুনি, ময়না, টিয়াসহ নানা ধরনের ছোট ছোট পাখি রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে। পশুপাখি ও পতঙ্গকুলের আচরণ বিকিরণের কারণে বদলে যাচ্ছে। আচরণের সঙ্গে এসব প্রাণীর প্রজননের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এক কথায় সব প্রাণীকূলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিটি কোম্পানিকে স্বল্প সংখ্যক সিমকার্ড বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বেনামী সিমকার্ড বিক্রি বন্ধ করতে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফোন কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহক সংখ্যা বাড়িয়ে অধিক মুনাফা করার জন্য বিভিন্ন অফার দিয়ে সিমকার্ড বিক্রি করছে। যার অধিকাংশেরই কোন মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। কারণ দেশে হালে প্রযুক্তিগত অপরাধের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এসব প্রযুক্তিগত অপরাধের সঙ্গে কোন না কোনভাবে মোবাইল ফোনের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। অথচ ওইসব মোবাইল ফোনের সিমকার্ডের অধিকাংশই বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা। পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটিত করার জন্য মোবাইল ফোনের বেনামি সিমকার্ড বেচাকেনা থেমে নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া সিমকার্ড বিক্রি ও সচল না করার নির্দেশনা থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই তা কার্যকর হচ্ছে না। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হুন্ডি ব্যবসা, প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায়, জ্বিনের বাদশা, হ্যালো পার্টির প্রতারণা, মানব পাচার এবং নাশকতায় ব্যবহৃত অর্থের লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে এ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করায় অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিয়ম না মেনে লেনদেন করার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। এসব মোবাইলের সিমকার্ডের অধিকাংশই বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা। ফলে প্রকৃত অপরাধীদের অনেক সময়ই গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে ও গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রেও মোবাইল ফোনের ব্যবহার করার তথ্য মিলেছে। এসব মোবাইল ফোনের অধিকাংশ সিমকার্ডই বেনামে রেজিস্ট্রেশন করা। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই ভুয়া রেজিস্ট্রেশনে মোবাইল ফোনের সিমকার্ড বিক্রির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তারা একজনের বায়োমেট্রিক নিয়ে অন্য ব্যক্তির নামে সিম রেজিস্ট্রেশন ও বিক্রির দায়ে এয়ারটেলের কর্মকর্তাসহ ২২ জনকে আটক করেছিল। আর কাওরানবাজার, ফার্মগেট, তেজতুরিবাজার, তেজকুনিপাড়া ও ইন্দিরা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে এয়ারটেলের এক লাখ সিমকার্ড জব্দ করেছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কয়েকজন এয়ারটেলের কর্মকর্তাও ছিলেন। বিটিআরসি ও মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পুলিশ এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখছে। পাশাপাশি সিমকার্ড বিক্রি ও এর সার্বিক কর্মকা-ের বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, দেশে অপরাধ অনেক কমে যাবে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, সঠিক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনের সিমকার্ড বিক্রি করা সম্ভব হলে, অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কম পরিমাণে সিমকার্ড বিক্রির প্রথা দ্রুত কার্যকর করা দরকার। কারণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে ব্যক্তি সাধারণত নিজের নামে বহু সিমকার্ড তুলেন, অধিকাংশই ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ওইসব সিমকার্ড পুরোপুরি সঠিক কাজে ব্যবহৃত হয়নি। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই গ্রামীণ ফোন ও বাংলা লিংকের তরফ থেকে তাদের কাছে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে। কোম্পানি দুইটির দাবি, তাদের মোবাইল ফোনের টাওয়ারে ব্যবহৃত দামী দামী ব্যাটারি চুরি হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে তাদের ব্যবসার চরম ক্ষতি হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রামীণ ফোনের টাওয়ার থেকে ব্যাটারি চোর চক্রের প্রধানসহ সাতজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। নাদিমুজ্জামান (২৮) চক্রের প্রধান। তার সহযোগীরা হচ্ছে, সাব্বির হোসেন ওরফে রাজীব (৩০), সানাউল (২২), মফিজ (২৬), বাবুল (৩০), শফিকুল ইসলাম (৩৫) ও হারুন (৩৬)। তাদের মিরপুরের পীরেরবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, তারা বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও গ্রামীণফোন কোম্পানির লোগো সংবলিত বেশ কিছু ব্যাটারি চুরি করেছে। তারা বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি যে ধরনের গাড়ি দিয়ে টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে, সেই ধরনের গাড়ি ভাড়া নেয়। গাড়ির সামনে ওইসব মোবাইল ফোন কোম্পানির লোগোযুক্ত স্টিকার লাগায়। এরপর তারা দিব্যি মানুষের সামনে দিয়ে ওইসব গাড়ি থামিয়ে সেখান থেকে ব্যাটারি চুরি করে নিয়ে যায়। দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের ধারণা, তাদের গায়ে যেহেতু ফোন কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত পোশাক আছে এবং গাড়ি ব্যবহার করছে, অতএব তারা ফোন কোম্পানির লোক। এভাবেই বাংলা লিংক কোম্পানির বহু ব্যাটারি চুরি হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রায় পাঁচ শ’ জিডি রয়েছে সারাদেশের থানাগুলোতে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ফোন কোম্পানিগুলো যদি বিটিআরসির নির্দেশনা মোতাবেক লোকালয় থেকে দূরে টাওয়ারগুলো স্থাপন করে, তাহলে ব্যাটারি চুরি কমে যাবে। এতে করে ফোন কোম্পানিগুলো লাভবান হবে। আর শিশুসহ প্রাণীকুল মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর রেডিয়েশনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
×