ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পপি দেবী থাপা

জানালার ওপারে বুলবুল

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯

জানালার ওপারে বুলবুল

২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার, ভোর। সকালের সূর্য জেগে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে নিভে গেল বাংলা সঙ্গীতের সুরের পাখি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জীবন প্রদীপ। এ শহরের ঘুম ভাঙ্গার আগেই জেগে ওঠে শোক। শহর জড়ানো কুয়াশার চাদরেও যেন শোকের ছোঁয়া। কিছুটা অভিমানী, জীবদ্দশায় নিভৃতচারী মানুষটা- মৃত্যুর মধ্যে শোরগোল ছড়িয়ে দিলেন চারদিকে। শোকে স্তব্ধ বাংলা সঙ্গীত ভুবন, সারা দেশ। এই দেশেরই প্রয়োজনে একদিন কৈশোরে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। ঠিক তেমনি তাকে দেখেছি সমান সাহসে সাক্ষ্য দিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধেও। বিনিময়ে ছিল না কোন প্রত্যাশা। সুবিধাবাদের পায়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এই শহরে তিনি ছিলেন স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের যে অহঙ্কার তাকে ছুঁয়ে ছিল কৈশোরে তা বিকিয়ে দেননি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অন্তত এ কারণে হলেও তার কাছে আমাদের আগামী দিনে ফিরতে হবে বার বার। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫৬ ঢাকায়। ’৭১-এ মাত্র সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়সে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের অধীনে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন বার বার। গুলি করার উদ্দেশ্যে গোসল করিয়ে কলেমা পর্যন্ত পড়ানো হয়েছিল। হঠাৎ করেই অজ্ঞাত নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাণ রক্ষা। ঠাঁই হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে। ভাল ইংরেজী বলতে পারার কারণে ক্যাপ্টেন ইফতেখার তাকে পাকবাহিনীর হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বুলবুল। ’৭১-এর রমজান মাসে বয়স বিবেচনায় সাধারণ ক্ষমায় পান মুক্তি। বাড়ি ফিরে খেতে চেয়েছিলেন মায়ের কাছে। কিন্তু সে খাওয়া হয়নি। মাত্র খেতে বসা বুলবুলকে আবার ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। এমপি হোস্টেলের নির্যাতন কক্ষে তার ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। যে নির্যাতনে সংজ্ঞাহীন ছিলেন আড়াই দিন। যুদ্ধচলাকালীন বাকি সময় কেটেছে রমনা থানায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীরত্বের জন্য তার হতে এক হাজার টাকার চেক তুলে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেতে ওঠেন দেশের গান তৈরিতে। টানা ৮ বছর শুধু দেশের গান করেছেন। ১৯৭৮ এ ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। দু’বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রথমটি ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ সিনেমার জন্য অপরটি ‘হাজার বছর ধরে’। এ ছাড়াও সঙ্গীতে অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কার নিয়ে পুরস্কারের ঝুলিটাও সমৃদ্ধ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গেছে তার সুর করা দেশাত্মবোধক গান। বুলবুল নামটি উচ্চারিত হলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে’, ‘একাত্তরের মা জননী’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’ এমন কিছু অমর সঙ্গীতের সুর ¯্রষ্টার নাম। তার বেশিরভাগ দেশাত্মবোধক গানের শিল্পী ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। কাজ করেছেন রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, এন্ড্রু কিশোরসহ সমকালীন সব বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে। তিনি প্রেমের জন্য লিখেছেন- ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘ভাড়া কইরা আনবি মানুষ’, ‘প্রেমের তাজমহল’সহ আরও বহু জনপ্রিয় গান। নিজেকে ফলাও করে প্রচার করেননি কখনই। বরাবরই ছিলেন শান্ত, নিরীহ, নির্ঝঞ্ঝাট। নিজের মত থাকতে ভালবাসতেন নীরবে-নিভৃতে। মৃত্যুর আগের কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন গৃহবন্দী হয়ে। যুদ্ধাপরাধী মামলায় সাক্ষী ছিলেন তিনি। অনেকেই যেখানেই টাকা আর জীবনের শঙ্কায় স্বাধীনতা বিরোধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সাক্ষ্য দিতে চাননি, সেখানে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন এই গানের মানুষ। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শঙ্কাহীন চিত্তে দিয়েছেন সাক্ষ্য। যেন ফিরে গিয়েছিলেন কৈশোরে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই দিনগুলোতে। এ জন্য তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে যথেষ্ট। হারিয়েছেন ছোট ভাইকে। খিলগাঁও রেল লাইনে পাওয়া গিয়েছিল ভাইয়ের গলাকাটা লাশ। নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন তখনই। এর মধ্যে আসতে শুরু করে তার নিজের জীবনের ওপর হুমকি। বাঁধা পড়েন সরকারী নিরাপত্তা বলয়ে। প্রায় ছয় বছর কাটান গৃহবন্দী জীবন। সঙ্গী বলতে ছিলেন একমাত্র পুত্র সামির ও একান্ত সহকারী রোজেন। নিয়মিত গান করাও হয়নি। কমে গিয়েছিল গানের মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা বা আড্ডা। এ সময় হৃদযন্ত্রে আটটি ব্লক ধরা পরে। চাইলেই দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে পারতেন, মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী তাকে সে সুযোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার গভীর দেশপ্রেম তাকে দেশ ত্যাগ করতে দেয়নি। দেশেই চিকিৎসা নিয়েছেন। তার ইচ্ছা ছিল অপারেশনের আগে বুকে থাকবে জাতীয় পতাকা এবং পতাকার ওপর পবিত্র কোরান। কারও সাহায্যের দ্বারস্থ হননি। কেবল বাংলা সঙ্গীতের কিংবদন্তি হিসেবে নয়, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ছিলেন এক আত্মমর্যদাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক। গৃহবন্দী জীবনে মুক্তির আকাক্সক্ষা জানিয়েছেন বার বার। অবশেষে সব দুশ্চিন্তা, অভিমান কাটিয়ে চিরশান্তির নিদ্রায় গেলেন বুলবুল। তিনি এখন অন্য সুরালোকের বাসিন্দা। নতুন গন্তব্যে যাত্রা শুভ হোক গুণী। অদেখা ভুবনে শান্তিতে থাকুন সবার প্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, গানের মানুষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আমরা জানালা খুলে রেখেছি, জানি আপনি আসবেন চুপিচুপি আপনার প্রিয় স্বদেশের মাটির ঘ্রাণ নিতে।
×