ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তোফায়েল আহমেদ

ঊনসত্তরের শপথ দিবস

প্রকাশিত: ০৯:০০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ঊনসত্তরের শপথ দিবস

ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জাতীয় জীবনে সবিশেষ গুরুত্ববহ। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। আর ’৬৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করে দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ‘ভোটাধিকার’ অর্জন এবং প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারামুক্ত করে। সত্যিকার অর্থেই ’৫২-এর রক্তধারা ’৬৯-এর রক্তস্রোতে মিশে ’৭১-এ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায়। বাঙালীর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এ-এক ঐতিহাসিক পরম্পরা। ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু’ কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আমার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রউফ (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ; এবং ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী এবং আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে- কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। পরে এনএসএফের একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল (প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন। দশজন ছাত্রনেতার উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে- ছয় দফা দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে- ছয় দফাকে দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত এগারো দফার ৩ নম্বর দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করি। বাস্তবত ১১ দফা ছিল ৬ দফারই সম্প্রসারিত রূপ। যাতে ধারিত হয়েছিল বাংলার গণমানুষের জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষা। ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। এরই প্রতিফলন দেখতে পাই আমাদের ঘোষণার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়নে। আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম গুলিস্তানে- এখন যেখানে মহানগর নাট্যমঞ্চ তার পাশের পার্কটির নাম হবে শহীদ মতিউরের নামে, ‘শহীদ মতিউর পার্ক’; যেটি ছিল আইয়ুব গেট, সেটির নামকরণ করেছি শহীদ আসাদের নামে, ‘আসাদ গেট’; আর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষিত আইয়ুব নগরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, বাংলার কৃষক দরদী নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজুলর হকের নামে, ‘শেরেবাংলা নগর’। মুক্তিকামী বিক্ষুব্ধ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নামগুলো পাল্টে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। পরম শ্রদ্ধাভরে উক্ত স্থানগুলোতে শহীদদের নামাঙ্কিত নামফলক স্থাপন করা হয়। দেশের সর্বত্র সর্বব্যাপী গণবিক্ষোভ এমন ছিল যে, স্বৈরশাসক ভীত হয়ে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবত রাখে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সমাঝোতার কথা বলেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে রেখে এবং ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোন সমঝোতা হবে না পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে আমরা আইয়ুব খানের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং এক সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আমাদের ১১ দফা দাবির ২ নম্বর দফাটি ছিল, ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক্ স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’ এই দাবির একাংশ মেনে নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ওপর থেকে স্বৈরশাসক আরোপিত বাজেয়াফত আদেশ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে শহীদ আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-আলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহাসহ সকল শহীদের রক্তের শপথ নিয়ে বলেছিলাম, ‘এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।’ শহীদের আত্মদান বৃথা যায়নি। পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। তাদের আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতায় আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন এবং আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। পল্টনে জীবনের প্রথম জনসভা। এই দিনেই আমরা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশজন ছাত্রনতা লাখ লাখ মানুষের সামনে ‘জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি আদায়ের শপথ গ্রহণ’ করি। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ‘শপথ দিবস’ পালিত হয়। জনসভা তো নয় যেন বিশাল এক গণমহাসমুদ্র! চারদিক কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সেদিনের সুবিশাল পল্টন ময়দান সংগ্রামী জনতাকে ধারণ করতে পারেনি। কাজ বন্ধ রেখে দাবি আদায়ে-কারখানার শ্রমিক, মেহনতী কৃষক, নৌকার মাঝি, জেলে, কামার-কুমার-তাঁতী, ছাত্র, অফিসের কেরানী, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী- সকলেই জনসভায় ছুটে এসেছে প্রাণের টানে। মানুষ ঠাঁই নিয়েছে স্টেডিয়ামের দোতলা-তিনতলার বারান্দায়, কার্নিশে। যে যেখানে পেরেছে স্থান করে নিয়েছে। গণতরঙ্গে উত্তাল বিশাল সেই জনসভায় আগত জনসাধারণ ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাদের মুখে ছিল স্বাধিকারের দৃপ্ত স্লোগান আর চোখ ছিল দুর্জয় সঙ্কল্পে অটল। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যপট এখনও আমার স্মৃতিতে অম্লান। পল্টনের সেই জনসমুদ্রে শিল্পী অজিত রায়ের ভরাট কণ্ঠে যখন গীত হলো, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’, তখন জনতরঙ্গে যে ঢেউ উঠেছিল তা অভূতপূর্ব। সে দৃশ্য কোন দিন ভুলবার নয়! সুতরাং এমন একটি দিন যে দিনে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন ডাকসুর ভিপি হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করার। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় দেশের বিভিন্নমুখী সমস্যার উল্লেখ করে, ঐতিহাসিক ১১ দফা ব্যাখ্যা করে, ছাত্রদের রাজনীতি করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে, আইয়ুব খান প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠক প্রশ্নে ছাত্রসমাজের অভিমত ব্যাখ্যা করে দশজন ছাত্রনেতার প্রত্যেকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘অবিলম্বে আইয়ুব খানের পদত্যাগ, বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল, রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি সম্পূর্ণ নূতন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে গণপরিষদ গঠন।’ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক এবং সভার সভাপতি হিসেবে পিনপতন নীরবতার মধ্যে একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করি। সেদিনের বক্তৃতায় যা বলেছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকের পাতা থেকে তার কিয়দংশ আজ পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি,- ‘প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত আলোচনা বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ছাত্র-জনতার কতিপয় দাবি আদায়ে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনর্প্রবর্তনের আহ্বান জানাই। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের পত্রিকা ‘ইত্তেফাক’কে আমরা ছিনিয়ে এনেছি। দেশরক্ষা আইনের প্রয়োগ বন্ধ করেছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কারাগার হতে মুক্তি পেতে শুরু করেছে। এ দেশের যে নেতা জন্মের পর হতে বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, সেই প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার দাবি-দাওয়া যদি পূরণ না করা হয়, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর যদি মুক্তি দেয়া না হয়, তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটবে। সমগ্র পাকিস্তানে জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন বাঙালী। অতএব, আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান রচিত গ্রন্থ ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার’ গ্রন্থটি বাংলার কোন ঘরে যেন না থাকে। রাজনীতির অর্থ যদি হয় শ্রমিক-কৃষকের অধিকার নস্যাত করা, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা, ছাত্রসমাজ সেই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু রাজনীতির অর্থ যদি হয়, দেশের ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নতুন সমাজ গঠন করা- ছাত্রসমাজ সেই রাজনীতি অবশ্যই করবে। ছাত্রদের ১১ দফা এই দৃষ্টিতেই প্রণীত হয়েছে এবং এই ১১ দফা কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের মুক্তি সনদ। আমরা শিল্পপতি-জমিদারের ছেলে নই, আমরা কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্তের সন্তান। আমাদের মাতাপিতার যদি অধিক ট্যাক্স দিতে হয়, তারা যদি পাটের ন্যায্য মূল্য না পান তাহলে আমাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্রদের পড়াশোনার সাথে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিচ্ছিন্ন নয়। পূর্ব বাংলার মানুষ বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। জনকল্যাণের রাজনীতিই তাদের ধর্র্ম। গরিব ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার হতে বঞ্চিত করার জন্য ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ প্রভৃতিসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকার প্রাদেশিকীকরণ করেছেন। ভবিষ্যত বংশধরদের মনে বিষ ছড়াবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে কোন কিন্ডারগার্টেন এবং ইংরেজী মাধ্যম স্কুল রাখা চলবে না। যেসব বেসরকারী কলেজ সরকারী কলেজে পরিণত হয়েছে সেগুলোকে পুনরায় বেসরকারী মর্যাদায় ফিরিয়ে দিয়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সমানাধিকার দিতে হবে। মিল মালিকদের হুঁশিয়ার করে বলছি, নিজেদের ভাগ্য গড়ার সঙ্গে সঙ্গে অচিরেই তারা যেন শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দানের ব্যবস্থা করেন। যাতে ভবিষ্যতে তারা আর নিজেদের ফরিয়াদ জানাতে ছাত্রদের কাছে ধর্ণা দিতে বাধ্য না হয়। অন্যথায় দেশের ছাত্রসমাজ তাদের ক্ষমা করবে না।’ বক্তৃতার শেষে সমবেত জনতার তুমুল গর্জনের সাথে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ ’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করে ৯ ফেব্রুয়ারি এক মোহনায় শামিল করেছিল। ভাবতে আজ কত ভাল লাগে ঐতিহাসিক শপথ দিবসের এই স্লোগানের দুটি লক্ষ্যই সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি। সোনার বাংলার ৩৯ জন সোনার সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করেছি। আর ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণরায় নিয়ে, ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করে সেদিনের সেই শপথবাক্যের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করেছি। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে আমাদের সংগ্রামী ভূমিকা, কর্মসূচি পালনে নিষ্ঠা, সততা ও জনদরদী আবেদন মানুষের হৃদয়ে এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে, বাংলার মানুষ আমাদের মাথায় তুলে নিয়েছিল। ৯ ফেব্রুয়ারির শপথ দিবসের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক-এর (ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি) মিটিংয়ে সভাপতি হিসেবে নুরুল আমীনের নাম প্রস্তাব করা হলে সংগ্রামী জনতা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে আমাকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন আন্দোলন চরম উচ্চতায় উঠেছিল; ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করা হলে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়ার পর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আজ যখন ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল ৯ ফেব্রুয়ারি ‘শপথ দিবস’-এর সোনালি দিনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন ফেলে আসা সংগ্রামী দিনগুলোর জ্যোতির্ময় বৈপ্লবিক বহির্প্রকাশ, অনন্য-সাধারণ মনে হয়! সংগ্রামমুখর সেই দিনগুলোর কথা এবার আরও বেশি করে মনে পড়ে। মনে পড়ার অনেক কারণ আছে। মনে হয়, আমরা বেঁচে আছি ঠিকই। কিন্তু আমাদের জীবনে এই দিনগুলোই ছিল শ্রেষ্ঠতম সময়। প্রতিনিয়তই ভাবি, একদিন আমিও চলে যাব। কিন্তু রয়ে যাবে আমাদের এসব ঐতিহাসিক কীর্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৌভাগ্যবান। দেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলার অবহেলিত গায়ের সন্তান আমি। সেই ছোট্টবেলায় কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। সেই অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে আজ জাতীয় রাজনীতির যে পর্যায়ে আমার অধিষ্ঠান, তা সম্ভবপর হয়েছে কেবলই গণমানুষের অপার ভালবাসায়। সেই ’৭০-এ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি; ’৭২-এ প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব; আবার ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী করেছেন। ’৯৬-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করলে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেছেন। ২০০৯-এ জাতীয় সংসদে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। এরপর ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন সরকারে শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে, ২০১৪-এর বিজয়ের পর বিগত ৫ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। এবারের সর্বশেষ নির্বাচনে ৮ম বারের মতো জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের খেদমত করবার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে যা প্রাপ্য তার সবই পেয়েছি। যতদিন বেঁচে আছি স্মৃতির পাতায় ভেসে থাকবে ’৬৯-এর অগ্নিঝরা উত্তাল সেই দিনগুলো। যে দিনগুলো আমার মতো একজন অখ্যাত মানুষকে সারা বাংলার মানুষের কাছে পরিচিত করেছিল। পরম করুণাময়ের কাছে একটাই প্রার্থনা আমি যেন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে শেষ জীবন ত্যাগ করতে পারি। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য
×