ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু ও নোবেল সমাচার

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু ও নোবেল সমাচার

মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, ভারতের জাতির পিতা। ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। অহিংস মতবাদ বা দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। সারাবিশ্বে স্বাধীনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা। ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। দিনটি সরকারী ছুটির দিন এবং গান্ধী জয়ন্তী হিসেবে ভারতে দিনটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। ১৫ জুন, ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ এ দিবস পালনে সম্মতিজ্ঞাপন করে। ভারতীয় নিপীড়িত সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধী প্রথম অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার ছিল না। এই অধিকার আদায়ের বিল উত্থাপনের জন্য তিনি কিছুদিন আফ্রিকায় অবস্থান করেন। বিলের উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হলেও এই আন্দোলন সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে সচেতন করে তুলেছিল। ১৮৯৪ সালে মহাত্মা গান্ধী ন্যাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমেই সেখানকার ভারতীয়রা রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়। ১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল সরকার উপনিবেশের ভারতীয়দের নিবন্ধনে বাধ্য করার জন্য একটি আইন পাস করে। ১১ সেপ্টেম্বর জোহানসবার্গে সংঘটিত এক গণপ্রতিরোধে মহাত্মা গান্ধী সবাইকে এই আইন বর্জন করতে বলেন। তিনি বলেন, এই আইন না মানার কারণে তার ওপর যে অত্যাচার করা হবে প্রয়োজনে তা মেনে নেবেন কিন্তু আইন মানবেন না। তার এই পরিকল্পনা কাজ দেয় এবং সাত বছর ব্যাপী এক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এই আইন অমান্য করা, নিজেদের নিবন্ধন কার্ড পুড়িয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক ভারতীয়কে বন্দী করা হয়। অনেক আহত বা নিহত হয়। সরকার তার কাজে অনেকটা সফল হয় কিন্তু শান্তিকামী ভারতীয়দের ওপর এহেন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ শুরু হয়। অগত্যা দক্ষিণ আফ্রিকার জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান স্মুট মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমেই মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়। মহাত্মা গান্ধী তার এ আন্দোলন সফল করতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় কারাভোগ করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী অস্ত্র ছিল অসহযোগ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী তার অহিংস নীতির পরিবর্ধন করে স্বদেশী পলিসি যোগ করেন। স্বদেশী পলিসি মতে, সকল বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাক পরিহার করে ধুতি পরার আহ্বান জানান। তিনি ভারতীয় পুরুষ, মহিলা, ধনী, গরিব সকলকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। বাড়তি হিসেবে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের মাধ্যমে মহাত্মা গান্ধী জনগণকে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বর্জন, সরকারী চাকরি থেকে ইস্তফা ও ব্রিটিশ উপাধি বর্জনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের অভিযোগে ১৯২২ সালের ১০ মার্চ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে তাকে ছয় বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। অবশ্য দুই বছরের মতো কারাদন্ড ভোগের পর তিনি মুক্তি পান। মহাত্মা গান্ধী কলকাতা কংগ্রেসে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান অন্যথায় অহিংস নীতির পাশাপাশি পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেয়ার হুমকি দেন। মহাত্মা গান্ধীর এই আহ্বানের মাধ্যমে তরুণ নেতা সুভাষ চন্দ্র বোস এবং জহরলাল নেহরু, যারা অবিলম্বে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, তারা জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হন। ব্রিটিশ রাজ এই আহ্বানের কোন সাড়া দেয়নি। ফলে ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় পতাকার উন্মোচন হয় লাহোরে। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি লাহোরে মিলিত হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দিনটিকে ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপন করে। লবণের ওপর কর আরোপের বিরুদ্ধে ১৯৩০ সালের মার্চে তিনি ডান্ডির উদ্দেশে লবণহাটা আয়োজন করেন। ১১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডিতে পৌঁছান। হাজার হাজার ভারতীয় তার সঙ্গে হেঁটে সাগরের তীরে পৌঁছান। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার সফল আন্দোলন। ব্রিটিশরা এর বদলা নিতে গিয়ে ৬০ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা করতে লর্ড এডওয়ার্ড আরউইনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। মহাত্মা গান্ধী আর উইন প্যাক্টস হয় ১৯৪১ সালের মার্চে। ব্রিটিশ সরকার সকল গণআন্দোলন স্থগিতের বিনিময়ে সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে অনেকেই ভেবেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর দর্শনে মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশদের কখনও তাড়ানো যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র সংগ্রামের। কিন্তু না তার প্রয়োজন হয়নি। মহাত্মা গান্ধীর হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, আক্রমণ নয় ত্যাগ আর ভালবাসায় অস্ত্রের কাছে ব্রিটিশরা পরাভূত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় তারা। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লীর বিড়ালা হাউস মাঝে রাতকালীন এক পথসভায় ভাষণ দানকালে নাথরাম গডস এই মহান নেতাকে গুলি করে হত্যা করে। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শন বিশ্বের অনেক নেতাকে প্রভাবিত করেছিল। আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং ও জেম লওসন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। খান আব্দুল গাফ্ফার খান, আউং সান সুচিসহ আরও অনেকেই মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীদের মধ্যে মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, আউং সান সুচি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ মহাত্মা গান্ধী পাঁচ পাঁচ বার নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেলেও তাকে নোবেল দেয়া হয়নি। পরে অবশ্য নোবেল কমিটি তাকে নোবেল না দেয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে বাংলার শেষ সূর্য অস্তমিত হওয়ার মাঝে ভারতবর্ষে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয়। স্বাধীনতার সেই সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে যুগে যুগে বাঙালীরা নেতৃত্ব দিয়েছে, জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছে, আত্মহুতি দিয়েছে। সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, সুভাষ বোস, প্রীতিলতা ওয়ার্দার, কল্পনা দত্ত, চিত্তরঞ্জন, বীনা রায়ের মতো সাহসী ও ক্ষণজন্মা বাঙালীরাই স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালীর অধিকার আদায় আর বাঙালী জাতিসত্তাকে পৃথকভাবে তুলে ধরেছেন শেরেবাংলা এ, কে, ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ইংরেজদের ১৯০ বছর রাজত্ব শেষে ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামক স্বাধীন দুটি রাষ্ট্র। বাঙালী অধ্যুষিত এ অঞ্চল পরিণত হলো পাকিস্তানের উপনিবেশে। ইংরেজদের শোষণের পরিবর্তে শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালীরা কখনই পাকিস্তানীদের কাছে মর্যাদা পাবে না। পাকিস্তানীদের শাসনে তারা কখনই নিরাপদ নয়, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত নয়। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির জন্য পৃথক রাষ্ট্রের চিন্তা করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে সুদীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে, আন্দোলন করতে হয়েছে। তাঁর এ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে। শান্তিপূর্ণ হরতাল, অবরোধ, মিছিল, মিটিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি কখনও সন্ত্রাসী কর্মকা-কে বেছে নেননি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে। বরং গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করাই ছিল মূল লক্ষ্য। তারপরও বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান শাসনামলের ২৩ বছরের মধ্যে ১৪ বছরই বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করতে হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভাল করেই জানত, এই নেতাকে হজম করা যাবে না। তাই কখনও জেল-জুলুম, কখনও রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে ফাঁসির ভয়, কখনও প্রলোভন দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমি আমার জন্য রাজনীতি করি না। আমি রাজনীতি করি এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। যে দেশের মানুষ আমার ডাকে আত্মাহুতি দিতে পারে তাদের সঙ্গে বেঈমানি করে আমি রাজনীতি ছাড়তে পারি না। বঙ্গবন্ধু কথা রেখেছেন, তিনি রাজনীতি ছাড়েননি। বরং রাজনীতি করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার মানুষকে দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি জাতীয় পতাকা, একটি জাতীয় সঙ্গীত। মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি শুধু বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং বাঙালী জাতির নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্ব নেতা, বিশ্ব মানবতার নেতা। শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই তার জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন। অধিকার বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি তার মায়া-মমতা-ভালবাসা তাকে আন্তর্জাতিক নেতার মর্যাদা দিয়েছে। পৃথিবীর যেখানেই তিনি মানবতার অবক্ষয় দেখেছেন সেখানেই তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭২ সালে ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দক্ষিণ ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট (এনএফএল)-কে কূটনৈতিক মর্যাদা দিয়ে ঢাকায় তাদের দূতাবাস স্থাপন এবং বিনা ভাড়ায় দুটি সরকারী মালিকানার ভবন বরাদ্দ দেয়া ছিল তাঁর এক সাহসী পদক্ষেপ। কারণ, বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশ তখনও ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়নি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রচন্ড ক্ষীপ্ত। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি তার উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় মেলে। তৃতীয় বিশ্বের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর প্রকৃত জাতীয় মুক্তি, দারিদ্র্যতা, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, রোগব্যাধি থেকে মুক্তির সংগ্রামে বিশ্বব্যাপী যে সংগ্রাম ও দ্বন্দ্ব চলছিল তাতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল শোষিতের পক্ষে। তিনি বিশ্ব সভায় সকল দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মেলনে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, শাসক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রাম ন্যায় ও সার্বজনীন সংগ্রামের প্রতীকস্বরূপ। সুতরাং বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধিকার অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার লাখো লাখো মুক্তি সেনানীকে আত্মাহুতি দিয়ে হয়েছে। গায়ের জোরে বেআইনীভাবে এলাকা দখল, জনগনেণ ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে নস্যাত করার শক্তির ব্যবহার ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলছে এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ব্যর্থ হয়নি। আলজিরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, গিনিবিসাউ এ বিরাট জয় অর্জিত হয়েছে। এ জয় দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইতিহাস জনগণের পক্ষে ও ন্যায়ের চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। বঙ্গবন্ধুর এ ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে বিশ্ব-মানবতার ইতিহাসে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৭৩ সালের ২৩ মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদক অর্জন বাঙালী জাতির এক বিরল সম্মান। এ মহান অর্জনের ফলে জাতির পিতা পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে। বঙ্গবন্ধু ২৫.০৯.১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দানকালে তিনি বিশ্ব শান্তির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, পৃথিবীর বহু স্থানে অন্যায় অবিচার এখনও চলছে। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার জন্য। ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায়সঙ্গত জাতীয় অধিকার এখনও অর্জিত হয়নি। উপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছেনি। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরও দৃঢ়ভাবে সত্য। সেখানে জিম্বাবুইয়ে নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামে এখনও ব্যাপৃত। একদিকে অন্যায় অবিচারের ধারাকে উৎখাতের সংগ্রাম অন্যদিকে বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আজ বিশ্বের সকল জাতি পথ বেছে নেয়ার কঠিন সংগ্রামের সম্মুখীন। এই পথ বাছাই করার প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত। অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বুভূক্ষর তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শঙ্কিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগুবো না, আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যত গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যত হবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কামুক্ত। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করা সম্ভব হলে শুধু অর্থনৈতিক সঙ্কট দূর করার পরিবেশই গড়ে উঠবে না, এ প্রতিযোগিতায় যে বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে, তা মানব জাতির কল্যাণে নিয়োগ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক মহানায়ক, ইতিহাসের কিংবদন্তি, মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী। তিনি চেয়েছিলেন মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কামুক্ত একটি শান্তিময় পৃথিবী। সেখানে বিশ্বের সকল সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের আদান প্রদান ও সুষ্ঠু বণ্টনের দ্বারা কল্যাণের দ্বার উন্মোচিত এবং পৃথিবীর সকল মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা লাভ করবে। বঙ্গবন্ধুর এ চিন্তাধারা এবং আদর্শকে বিশ্ব শান্তি পরিষদ যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার প্রদান করেছে। কিন্তু নোবেল কমিটি বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা এবং আদর্শকে যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। এটা নোবেল কমিটির ব্যর্থতা। তাদের এই ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নিলে নোবেল এবং নোবেল কমিটি উভয়েরই মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। লেখক : গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
×