ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী হাসপাতাল এবং চিকিৎসাসেবা

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 সরকারী হাসপাতাল এবং চিকিৎসাসেবা

ডাক্তার, নার্স ও দালালদের দৌরাত্ম্যে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারী হাসপাতালের রোগীরা। এমন পরিণতিতে হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার নামে চলমান নৈরাজ্য দেখার যেন কেউ নেই। অবশ্য হাসপাতালগুলোর এই অবস্থা কয়েক দশকের। অভিযোগ রয়েছে দেশের জেলা শহরের বেশিরভাগ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল নেই। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। এসব হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। আবার কোন কোন হাসপাতালে একাধিক এমবিবিএস কর্মরত। যেখানে এমন ডাক্তারের স্বল্পতা সেখানে ডাক্তারের সহকারী ও ওয়ার্ডবয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা। হাসপাতালসমূহে শুধু ডাক্তার সঙ্কট নয় বরং সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ অন্যান্য বিভাগের লোকবল চরম সঙ্কটে। জেলা সদর ও উপজেলার বেশিরভাগ হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন, ডেন্টাল যন্ত্রপাতি, প্যাথলজিস্ট যন্ত্রপাতি, আর্ট বিভাগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বহু নাম না জানা মূল্যবান চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার আশায় আগত সাধারণ মানুষ ওই সমস্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিভাগীয় শহরের সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে বেহাল দশা। একটু ভাল আর বিনামূল্যে সরকারী স্বাস্থ্যসেবা পেতে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড় আশা নিয়ে দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে আসেন। কিন্তু এখানে এসেই তাদের পড়তে হয় বিপাকে, নানা বিড়ম্বনায়। হাসপাতালের প্রবেশ গেট থেকে শুরু করে কেবিন, বেড পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এক শ্রেণীর দালাল চক্র। নানা প্রলোভন যেমন দ্রুত ডাক্তার সেবা পাইয়ে দেয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধ, থাকার জন্য কেবিন ইত্যাদি দেখিয়ে তারা দরিদ্র ও সহজ সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক রকম সর্বশান্ত করেই ছাড়েন। এদের খপ্পরে পড়ে অনেককেই চিকিৎসাসেবা তো দূরের কথা উল্টো অসুস্থ হয়ে কখনও হাসপাতালের বারান্দায়ও শুয়ে কাতরাতে দেখা যায়। ওইসব দালালরাই এই পর্ব শেষে আবার সরকারী মেডিক্যালের কাজের হতাশাপূর্ণ বর্ণনা দিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ ডাক্তাররা তাদের সরকারী কর্মক্ষেত্রের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেই বেশি প্রাধান্য দেন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হচ্ছে, ডাক্তাররা কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি। দামী গিফট কিংবা বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় অনেক সময় ওইসব প্রতিনিধিদের সঙ্গে ডাক্তারদের গল্প ও আলাপ-চারিতায় মেতে উঠতে দেখা যায়। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমেও লাইনে অপেক্ষমাণ থাকা রোগীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাই হয়ে উঠেন সর্বেসর্বা। রোগী দেখা থেকে শুরু“করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছেন অবলীলায়। সুযোগ-সুবিধাহীন সরকারী হাসপাতালে একশ্রেণীর ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগীরা থাকছেন বড়ই অসহায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরাসহ অন্যান্য রোগীরা পর্যাপ্ত ওষুধ থাকা সত্ত্বেও সঠিকভাবে ওষুধ পান না। ডাক্তারদের লেখা সিøপ নিয়ে ওষুধ আনতে গেলেই ২-১টা সস্তা ওষুধ দিয়ে বলা হয় বাকিগুলো স্টোরে নেই তাই বাহির থেকে কিনতে হবে। অথচ বাহিরের ফার্মেসিতে গেলেই দেখা যায় না পাওয়া ওষুধগুলো অগ্নিমূল্য। এতসব দামী ওষুধগুলো তাহলে যায় কোথায়? দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মন-মানসিকতার কবলে পরে সাধারণ মানুষ সরকারী চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় নিকটস্থ বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে সেবা নিতে গিয়েও সাধারণ রোগীরা পড়েন হতাশা ও যন্ত্রণায়। উন্নত চিকিৎসার নামে চাকচিক্য ওইসব ক্লিনিকে ভাল চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। সাধারণ রোগীরা চিকিৎসকদের নামী-দামী ডিগ্রী দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। অথচ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও রয়েছে উন্নত চিকিৎসাসেবা। বড় বড় ও জটিল রোগের অপারেশন করার মতো সরকারী ব্যবস্থা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতিও এদেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। তাহলে কেন রোগীরা এত সব চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন? বর্তমান সরকার চিকিৎসা সেবা ও খাতে অনেক বড় বাজেট রাখে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, অসংখ্য ডাক্তার নিয়োগ ইত্যাদি কমবেশি সকল ব্যবস্থা থাকলেও সেই হিসেবে নেই চিকিৎসা সেবা। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে বার বার ডাক্তারদের অবহেলা, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির চিত্র দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এসব ডাক্তারদের চাকরি ছাড়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সরকারী হাসপাতালে দালালদের উৎখাত ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল জোরদার করাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি ডাক্তাররা যেসব যৌক্তিক সমস্যায় জর্জরিত সেগুলোকেও আমলে নিতে হবে। এছাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে দ্রুতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে তবেই সাধারণ জনগণের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে। লেখক : প্রকৌশলী [email protected]
×