ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কর্ণফুলী টানেল সড়কে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলবে

প্রকাশিত: ১১:০০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কর্ণফুলী টানেল সড়কে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলবে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশের প্রথম কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। নিরাপত্তা চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। এক সময় চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বিষয়টি একেবারেই অবিশ^াস্য মনে হতো। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতোই এ প্রকল্পটি নির্মাণে সরকার সব সময়ই অনড় অবস্থানে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণে খুশি বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হলে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ আন্তর্জাতিক রুটের সঙ্গে যুক্ত হবে এই টানেল। ফলে বাড়বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও। প্রথম বছর এই টানেল দিয়ে ৬৩ লাখ যানবাহন চলাচলের সুযোগ পাবে। তিন কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য এই টানেলের নদীর তলদেশে গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট। উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। কেমন হবে টানেল ॥ নক্সা অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হবে তিন হাজার পাঁচ মিটার বা তিন কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে তা বের হবে ওপারে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। নদীর তলদেশের গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেকটি টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর ওপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে। পাশে হবে একটি সার্ভিস টিউব। মাঝে ফাঁকা থাকবে ১১ মিটার। যে কোন বড় যানবাহন দ্রুত স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে এই টানেল দিয়ে। ২৪ ফেব্রুয়ারি খনন কাজের উদ্বোধন ॥ আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে খনন কাজের উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার কর্ণফুলী টানেলের নিরাপত্তা বিষয়ে নৌবাহিনীর সঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি এ তথ্য জানান। রাজধানীর সেতু ভবনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি টিবিএম মেশিন দিয়ে খনন কাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়েছে। নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে নৌবাহিনী। অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। নৌবাহিনীর পক্ষে কমডোর মাহমুদুল মালেক এবং সেতু কর্তৃপক্ষের পক্ষে প্রধান প্রকৌশলী কাজী ফেরদৌস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কর্ণফুলী টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নৌবাহিনী প্রাথমিক চিকিৎসা এবং প্রকল্প এলাকায় একটি কার্যালয়ও স্থাপন করবে। চার লেনের তিন দশমিক চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ টানেল হবে দুই টিউব সম্বলিত। পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে হবে পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি নয় হাজার আট শ’ আশি কোটি চল্লিশ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহায়তা তিন হাজার নয় শ’ সাতষট্টি কোটি একুশ লাখ টাকা এবং চীন সরকারের অর্থ সহায়তা পাঁচ হাজার নয় শ’ তেরো কোটি উনিশ লাখ টাকা। টানেলটির দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার এবং টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজসহ এই টানেলটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে শহরাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি শতকরা ৩২ ভাগ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী আরও বলেন, চুক্তি অনুযায়ী নৌবাহিনীর সিকিউরিটি সাপোর্ট ইউনিট কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং চুক্তির মেয়াদ হবে ৪ বছর। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে রয়েছে ভারি শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর ওপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হয়েছে, যা বিরাজমান প্রচুর পরিমাণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয়। নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমা একটি বড় সমস্যা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতার জন্য বড় হুমকি। এই পলি জমা সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর আর কোন সেতু নির্মাণ না করে এর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকার চট্টগ্রাম জেলার দুই অংশকে সংযুক্ত করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেন, দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর মুখে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেশের আমদানি এবং রফতানি কর্মকা- পরিচালিত হয়। প্রস্তাবিত টানেল এ বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। প্রস্তাবিত টানেল সাইটে নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটার এবং পানির গভীরতা ৯-১১ মিটার। প্রস্তাবিত টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪০০ মিটার। ২০১৫ সালের ২৪ নবেম্বর প্রকল্প নির্মাণে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কর্ণফুলী নদীর নেভাল একাডেমি থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত সোয়া তিন কিলোমিটার হবে টানেলের দৈর্ঘ্য। এই দৈর্ঘ্যটুকুকে এখন চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নের সমান বলা যায়। এখানেই নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীর দিয়ে চলবে সারি সারি গাড়ি। সে লক্ষ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে দেশ তথা সার্কের প্রথম টানেল সড়ক। এখন সেখানে চলছে কর্মযজ্ঞ। তলদেশে মাটি খুঁড়ে টিউব ঢোকানোর জন্য চীন থেকে আনা হয়েছে অত্যাধুনিক বোরিং মেশিন। ৯৪ মিটার দীর্ঘ ও ২২ হাজার টন ওজনের এই মেশিন প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে গত বছরের জুলাই মাসে। জাহাজে করে চীন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আসা বিভিন্ন অংশ ফিটিং শেষে বোরিং মেশিনটি খননের কাজে লাগানো হচ্ছে। চট্টগ্রামে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি এসেছিল ২০০৮ সালে। লালদীঘি মাঠের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রতিশ্রুতি দেন। প্রথম প্রথম বাংলাদেশের জন্য প্রায় অসম্ভব মনে করে বিষয়টিকে ‘শুধুই জনসভার প্রতিশ্রুতি হিসেবে ভেবেছিল সবাই। কাজ শুরুর পর এখন সবাই আশাবাদী এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলে হাসি ফোটে সবার মুখে। দূর হয় সব শঙ্কা। এরপর জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণ কাজে অর্থছাড় করাতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকুই। এর পরই শুরু হয় নির্মাণ কাজ। সার্কে কর্ণফুলী টানেলই প্রথম ॥ ভারতে সড়ক যোগাযোগে স্থলভাগে টানেল থাকলেও নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম। মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত ৫০৮ কিলোমিটার হাইস্পিড রেল করিডর নির্মাণ করার পরিকল্পনা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করেছে ভারত। এরই মধ্যে ২১ কিলোমিটার সাগরের নিচ দিয়ে টানেল থাকবে। জাপানের সহায়তায় কাজটি চলতি বছরের শেষ দিকে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২২ সালে। তবে এটিও রেল টানেল। সে হিসেবে বাংলাদেশই নদীর তলদেশে সড়ক টানেল নির্মাণে সার্কের মধ্যে প্রথম হতে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ ॥ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজটি হাতে নেয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। এই সড়ক যাবে টানেলের ভেতর দিয়ে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-হালিশহরে বাস্তবায়নাধীন আউটার রিং রোড কাজ করবে টানেলের এ্যাপ্রোচ সড়ক হিসেবে। নগরী থেকে টানেল অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার যাবে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে। সেই আনোয়ারাতেই বাস্তবায়িত হবে চীনা ইকোনমিক জোন। উত্তর দিকে এই মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে বাস্তবায়নাধীন দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মীরসরাই ইকোনমিক জোন পর্যন্ত। আবার মীরসরাই ইকোনমিক জোন সম্প্রসারিত হচ্ছে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া মীরসরাই-সীতাকু-ের মাঝামাঝি এলাকায় নির্মিত হবে মাঝারি সাইজের একটি সমুদ্র বন্দর। নগরীর হালিশহর এলাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম বন্দরের তিনগুণ বড় বে-টার্মিনাল। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোন একসময় মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুত হাব। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। এই কর্মযজ্ঞ পৃথকভাবে চলমান থাকলেও মূলত সরকারের মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনারই অংশ। কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনসহ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে পাল্টে যাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের চেহারা, আর এর ছোঁয়া লাগবে সারাদেশে। কারণ এই চট্টগ্রাম হয়ে খুলে যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বার। বছরে চলবে ৬৩ লাখ গাড়ি ॥ চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অভি অরূপ এ্যান্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেড যৌথভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদন জমা দেয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে। এর ওপর ভিত্তি করেই চীন ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে সিসিসিসি এখন টানেলের নির্মাণ কাজ শুরু করছে। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা আছে, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের নিচ দিয়ে চলাচল করবে। এক সময় এই পরিমাণ এক কোটি ৪০ লাখে গিয়ে ঠেকবে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনার পরিবহনকারী ট্রেইলর ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস, আর ১২ লাখ কার, জীপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি।
×