ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির মহাসচিব থাকতে চান না ফখরুল

প্রকাশিত: ১১:০১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিএনপির মহাসচিব থাকতে চান না ফখরুল

শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর দল চলছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই। কিন্তু তারেক রহমান যেভাবে দল পরিচালনা করতে চাচ্ছেন সেভাবে চালাতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে তার সঙ্গে মতবিরোধ হচ্ছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। তিনি এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে সাজা শেষ হওয়ার আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আর দলের মহাসচিব থাকতে চাচ্ছেন না। এ বিষয়টি ইতোমধ্যেই তারেক রহমানকে জানিয়ে দিয়েছেন ফখরুল। সূত্রমতে, গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই লন্ডনপ্রবাসী তার ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এরপর থেকে তারেক রহমানের সঙ্গে ফোন ও স্কাইপিতে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। অবশ্য একাধিকবার লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখাও করে এসেছেন তিনি। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে না পারাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তারেক রহমান মির্জা ফখরুলের ওপর অসন্তুষ্ট হন। এ পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুল পদত্যাগ করার উদ্যোগ নিলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে তারেক রহমান কৌশলে মির্জা ফখরুলকে বশে রাখার চেষ্টা করেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৩০০ আসনের জন্য দল ও জোটের একটি খসড়া প্রার্থী তালিকা করে লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে পাঠান। কিন্তু তারেক রহমান সেই তালিকায় আমূল পরিবর্তন করে দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেন। এ তালিকায় দলের অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতার নাম না থাকায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন। মনোনয়নবঞ্চিতরা তারেক রহমানের পাশাপাশি মির্জা ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন। সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ মির্জা ফখরুলের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এ পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের প্রতি চরম নাখোশ হন মির্জা ফখরুল। তবে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে এ নিয়ে কোন কথা বলেননি। বরং তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেই নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যান। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভরাডুবির পর তারেক রহমান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণার জন্য চাপ দেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল কৌশলে তারেক রহমানকে বোঝাতে সক্ষম হন এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনে নামলে নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হবেন। বরং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিলে তা সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত হবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করেও যখন কোন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হয়নি তখন মির্জা ফখরুলের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন তারেক রহমান। এ ছাড়া নির্বাচনে পরাজয়ের পর সারাদেশের প্রতিটি আসনের প্রার্থীদের দিয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে মামলা করাতে বলেন তারেক রহমান। কিন্তু এক মাসের মধ্যে মামলা করবেন বললেও এ সময়ের মধ্যে মির্জা ফখরুল নিজে বা অন্য কাউকে দিয়ে মামলা করাতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগেই মির্জা ফখরুল তারেক রহমানকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আর বিএনপির মহাসচিব থাকতে চান না। সিঙ্গাপুর গিয়েও তারেক রহমানকে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। তবে মির্জা ফখরুল ইসলামের মহাসচিব থাকার বিষয়ে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার সায় থাকায় তারেক রহমান এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে নিজে কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে মামলা করাতে না পারায় তারেক রহমান বিষয়টি ভালভাবে নেননি। তবে তিনি অতি সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া কিছু নেতার সঙ্গে লন্ডন থেকে স্কাইপি বৈঠকে অংশ নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতি জেলায় একটি করে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তারেক রহমানের এ নির্দেশ কার্যকর করার বিষয়েও দলের অধিকাংশ নেতার অনাগ্রহ রয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে তারেক রহমানের নির্দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অন্তত ৫টি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে বেশ ক’জন নেতা শোচনীয় পরাজয়ের বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কৌশলে ভুল ছিল বলে অভিযোগ করেন। অপরদিকে মির্জা ফখরুলের পক্ষের নেতারাও এ জন্য অন্য পক্ষের নেতাদের পাল্টা দায়ী করে বলেন, কোথায় ভুল হচ্ছে সে কথা নির্বাচনের আগে না বলে এখন কেন বলা হচ্ছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে একাধিকবার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রমতে তারেক রহমানের পাশাপাশি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের একাংশ মির্জা ফখরুলকে আর মহাসচিব পদে দেখতে চাচ্ছেন না। কারণ, ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিলের পর মির্জা ফখরুল ইসলামকে মহাসচিব করার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি দলের অনেক সিনিয়র নেতা। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পছন্দ করেন না দলের এমন নেতারা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি। মির্জা ফখরুল কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডনপ্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কৌশলে ম্যানেজ করে ২০দলীয় জোট রেখেই নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় অন্যপক্ষের নেতারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। তবে তাদের মধ্যে তখন থেকেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনগুলোতে দলীয় মনোনয়নের সময় বাহ্যিক দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লন্ডনপ্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কারণে দলের সিনিয়র নেতারা প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। হাইকমান্ডের নামে দলে যে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে তার সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার ক’জন অনুসারী জড়িত বলেও তারা মনে করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের দু’একদিন আগেই যখন বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী সার্বিক পরিস্থিতি চরম বৈরী বলে মনে হয়েছে তখনই মির্জা ফখরুলকে বলা হয়েছিল নির্বাচনের দিন হলেও যেন বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। তারেক রহমানও নির্বাচন বর্জনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল নিজে বিজয়ী হবেন এমন সম্ভাবনা থাকায় হাইকমান্ডকে বুঝিয়ে নির্বাচন বর্জনের বিপক্ষে অবস্থান করেন। এ ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনকেও কাজে লাগান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। কিন্তু নির্বাচনে মির্জা ফখরুল ছাড়া সিনিয়র নেতাদের আর কেউ বিজয়ী না হওয়ায় তারা চরম ক্ষুব্ধ হন। এ ছাড়া বিএনপি থেকে যে ৬ জন নির্বাচিত হয়েছেন তারা যেন সংসদে না যান সে জন্য চাপ দিতে থাকেন। এ কারণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত ৬জন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। তবে তারা সংসদে যাওয়ার পক্ষে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সম্প্রতি বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য নাম প্রকাশ না করে দলের কিছু নেতার প্রতি ক্ষোভ ঝেড়ে দলে অন্তর্কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশ করেন। তারা জাতীয় কাউন্সিল ডেকে দলের নতুন কমিটি গঠন ও নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন। তারা নেতৃত্ব পরিবর্তন বলে মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে এ পদে বসানোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন বলেই বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। আর মির্জা ফখরুলবিরোধী বিএনপির দুই সিনিয়র নেতার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মহাসচিবপন্থী নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে গাছাড়া ভাব দেখিয়ে এখন পরাজিত হয়ে তারা সব দোষ মির্জা ফখরুলের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। মির্জা ফখরুল তো কোন কাজ তাদের আড়াল করে করেননি। সবকিছু দলীয় ফোরামে এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশেই করেছেন। এখন তারা মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নিজেরা এ পদে আসতে উদ্দেশ্যমূল কথাবার্তা বলছেন। আর এর মাধ্যমে তারা দলে অনৈক্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ চায় দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে আগের জাতীয় কাউন্সিলের ৩ বছর পর এ বছর মার্চ মাসের মধ্যে পরবর্তী কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করতে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল। সে হিসেবে মার্চের ১৮ তারিখই ৩ বছর সময় পার হয়ে যাবে। এবার জাতীয় কাউন্সিল হলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করবেন বেশ ক’জন নেতা। এদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা। আর এসব কিছু টের পেয়ে আগেভাগেই মির্জা ফখরুল মহাসচিব পদে না থাকার কথা তারেক রহমানকে জানিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বড় রাজনৈতিক দলে কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। তবে এক সময় আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে কখনও কখনও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আবার কখনও কখনও বড় বড় পদে পরিবর্তন আসে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে দেয়। আর এভাবেই দলীয় কর্মকা- চলে।
×