ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের ভাষা...

প্রকাশিত: ১৩:০১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

তারুণ্যের ভাষা...

ভাষার নিজস্ব গতি আছে। ভাষা পরিবর্তনশীল। আর ভাষা পরিবর্তনে যে তরুণরাই মুখ্য ভ‚মিকা রাখছে সেটা স্পষ্ট। বাড়ির তরুণ বা টিনএজারদের মুখে হরেক রকম নতুন শব্দের ফুলঝুরি শুনে হঠাৎ চমকে উঠেন অনেকেই! তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে ‘আজিব’ এসব শব্দের প্রবেশ খুদেবার্তা থেকে। এসএমএস লেখার জন্য প্রচলিত অনেক শব্দকেই ছেঁটে ছোট রূপ দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে এসব শব্দের ব্যাপক প্রচলন। সিনেমার চুম্বক কোন অংশ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কোন কিছু থেকে তরুণদের অভিধানে ঢুকে যাচ্ছে এক গাদা শব্দ। তরুণদের আড্ডায়ও আবার অঙ্কুরিত হচ্ছে এমন অনেক শব্দ। তরুণদের এই অদ্ভুতুড়ে শব্দ নিয়ে কিন্তু আগের প্রজন্মের ঘোর আপত্তি আছে। এই প্রজন্মের যুক্তি এমন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তো তারাও গেছেন। বিতর্ক অনেক হয়েছে। তরুণদের ভাষায় এবার বলতে হবে, ‘চিল ম্যান’। ইংরেজী শব্দ চিল অর্থ অস্বস্তিকর ঠাÐাভাব। তারুণ্যের অভিধানে এই শব্দের অর্থ হালকা হও বা মাথা ঠাÐা কর। ক্যাম্পাসে, তারুণ্যের আড্ডায় কান পাতলে ভেসে আসে এমনই অনেক শব্দ। একনজরে দেখে নেয়া যাক কিছু শব্দকে। আজিব-আজব কুল- আভিধানিক অর্থ ঠাÐা হলেও দারুণ কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাম্মা- বন্ধু থেকে শুরু করে টং দোকানের মালিক সবাই এই প্রজন্মের মামা। আবার জিগায়- এটা আবার জিজ্ঞাস করতে হয় নাকি তথা সম্মতি প্রদান। দূরে গিয়া মর- পাত্তা না দেয়া বা সম্মতি না দেয়াকে বোঝায়। জিনিস- অসাধারণ কিছু বোঝায়। রক্স- দারুণ, খুবই ভাল। অসাম- খুব ভাল কিছু। বেইল নাই- পাত্তা না দেয়া। অফ যা-ব্যঙ্গাত্মকভাবে থামতে বলা। ধরে দেবানি- জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার কল্যাণে প্রচলিত। এইডা কিছু হইল- এটা কোন ধরনের কথা! মজা লস- আপনি কি ইয়ার্কি করছেন? ফেসবুকের একটি মিম পেজের বদৌলতে ভাইরাল। কেউ আমারে মাইরালা- খুব বেশি অবাক হওয়ার অনুভূতি। পুরাই অস্থির- দুর্দান্ত কিছু বোঝাতে। ঠিকাসসসে ভায়াআআ- দৃঢ় সম্মতি প্রকাশ। হ্যাং আউট- তরুণদের বাঁধাহীন আড্ডা। হোয়াটস আপ- কি খবর কেমন যাচ্ছে? লোল- ষড়ঃং ড়ভ ষধঁমযং তার ছিঁড়া- এলোমেলো-অদ্ভুতুড়ে মস্তিষ্কের কোন মানুষ বা তার কাজ। খেলা হবে- ব্যঙ্গাত্মক বা অবজ্ঞাসূচকভাবে চমকপ্রদ কিছু হওয়ার কথা। ক্র্যাশ- কাউকে ভাললাগা। উরাধুরা- অগোছালো এলোমেলোর মতো বোঝায়। পুরাই টাশকি- আকাশ থেকে পড়া! প্যারা নাই- তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ভাষা বিকৃতি না ভাষার গতিশীলতা? বাংলা কি তার রাজকীয়তাকে হারাচ্ছে তাহলে? ভাষাবিদরা ভাষাকে তুলনা করেন স্রোতের সঙ্গে। কিছু শব্দ, কিছু উপাদান হারিয়ে যাবে সেই স্রোতে, আবার কিছু টিকে যাবে। প্যারা নাই। প্রজন্মের অভিধানের কি হয় সেটা সময়ই বলে দেবে। কী ভাবছেন তরুণরা সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ বিজ্ঞান লেখক ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায় কারণে অকারণে বদলায়’ এ কথাটি ভাষার জন্যও প্রযোজ্য। যে ভাষা বদলায় না সে ভাষা মৃত। তার একটা উদাহরণ সাধু ভাষা। ব্যাকরণ ও নিয়ম কানুন দিয়ে একটা ভাষাকে খুব একটা ধরে বেঁধে রাখা যায় না। কিন্তু আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে ভাষা পরিবর্তনের হার অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এর একটি বড় কারণ হলো সোশ্যাল মিডিয়া এবং এফএম রেডিও। আমরা ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা কথার মাঝে মাঝে ইংরেজী ও হিন্দী শব্দ মেশাচ্ছি। যেমন কোন গানের প্রশংসা করার জন্য বলছি কুল সং, ভাই বা বন্ধুকে বলছি ব্রো এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। সবসময়ের মতো এই পরিবর্তনকেও জোর করে বন্ধ করা যাবে না। তবে একটা জিনিস আমাদের উপলব্ধি করতে হবে ভাষা যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষও বদলে যাচ্ছে। মানুষের গভীরতা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি শব্দও তার মূল্য হারাচ্ছে। ভাষার এই পরিবর্তন আমাদের ভেতরকার কোন বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। মুমু আহমেদ শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। এক আত্মীয়া তার ২ বছর বয়সী ছেলেকে বলছে, ‘চিকেন দিব? একটু ফিশ খাও?’ আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে কথার অর্থোদ্ধার করতে পারলাম। স্মার্টনেস-প্রতিযোগিতার এই যুগে বাচ্চাদের সবজি খিচুড়ির সঙ্গে ইংরেজীটাও গিলতে হচ্ছে। এরাই আগামীর তরুণ, আগামীর ভাষার বাহক। ভাষা নদীর মতো বহমান। একে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া নিরর্থক। বিগত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া সাধু ও চলিত ভাষা ব্যবহারের যুদ্ধটা হতে পারে একটা আদর্শ উদাহরণ। শেষমেশ সেই ভাষাই চলে যা বলতে, লিখতে পড়তে সোজা। এক জুনিয়রকে কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে, বাংলা না পেয়ে ইংরেজী শব্দ বলেছিলাম। আসলে কিছু বিদেশী শব্দ এমন ভাবে বাংলায় ঢুকে গেছে যে, বাংলাটা থেকে ইংরেজীটা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। যেমন, আগের বাক্যে জুনিয়র না বলে, কনিষ্ঠ-অনুজ-নিম্ন শব্দগুলো ব্যবহার করলে আসল অর্থ বোঝাতে পারতাম কি? ওদিকে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতির কারণে বাংলা শিখতে পারছে না, আর এদিকে শহুরে শিক্ষার্থীদের জাতে-ওঠার অসুস্থ যুদ্ধে চলিত ভাষাটা যাচ্ছে হারিয়ে। একটা ভারসাম্য এখন সময়ের দাবি। ‘আজিব’ ‘ঈযরষষ’ সবই থাকুক। কিন্তু ‘আজব’টা যে শুদ্ধ ভাষা, এবং একগাদা ইংরেজী শব্দ না গুলিয়ে নিজের ভাষা শুদ্ধভাবে বলতে পারাটাও যে একটা ‘ংসধৎঃহবংং’, তরুণদের সেটা মাথায় রাখা উচিত। হিমেল হাসান তরুণ উদ্যোক্তা ‘এই মামা যাবেন?’ রিক্সা ডাকার সময় বর্তমানে প্রায় সবাই ‘মামা’ শব্দটাই ব্যবহার করি। শুধু রিক্সাওয়ালা না আগে যেখানে আমরা ভাই ব্যবহার করতাম সেখানে এখন মামা ব্যবহার করি। এটা ভাষার সহজাত বৈশিষ্ট্য, ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তনশীল। বর্তমানে যে বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বে তা এমন ছিল না এবং আজ থেকে চল্লিশ বছর পরেও এমন থাকবে না। সম্প্রতি কোকাকোলা বাংলার হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন শব্দ খুঁজে বের করে আমাদের কাছে তুলে ধরছে। অনেক পুরনো শব্দ যা বহুকাল আগে ব্যবহার করা হতো তা নতুনভাবে তরুণ প্রজন্ম ব্যবহার করা শুরু করছে। উদাহরণ দিলে বলতে হয়, ‘কড়া।’ আমাদের বন্ধুমহলে বহুল ব্যবহৃত এই শব্দটি যে আগেও প্রচলিত ছিল তা জানা ছিল না। পরিশেষে, কথা হচ্ছে ভাষার পরিবর্তন ঘটবে এটা যেমন সত্য তেমনি তা যেন অতিবিকৃত না হয় তার প্রতি সচেতন থাকাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা বিকৃতি করে অতি আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে বাংলার নিজস্ব সৌন্দর্য যেন হারিয়ে না যায়। অঙ্গন ফারিয়া বেতার কণ্ঠশিল্পী, আরজে যুগের সঙ্গে আপনি যখন তাল মিলিয়ে চলতে যাবেন তখন অনেক কিছুরই পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি। ব্যাপারটা যে শুধুমাত্র বাংলা ভাষা তা নয় কিন্তু! যদি ইংরেজীর দিকে তাকানো হয় তাহলেও অনেক অঞ্চলিক শব্দ দেখা যায়। যেমন ‘ঞযবৎব রং হড় ড়িৎফ পধষষবফ মড়ড়ফ-ষড়ড়শবৎ’। এই মড়ড়ফ-ষড়ড়শবৎ শব্দটি ভাষার গতিশীলতা বজায় রাখা বা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাতেও এ রকম অনেক শব্দ আমরা নিয়ে এসেছি। কিছু ক্ষেত্রে শব্দগুলো গ্রহণযোগ্য কিন্তু মাঝে মধ্যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। তখন আমার কাছে মনে হয় বাংলা ভাষা তার রাজকীয়তা হারাচ্ছে। যে ভাষার জন্য আমাদের এত রক্ত ঝরাতে হয়েছে, এত সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই ভাষার রাজকীয়তা হারাতে দেখা কষ্টকর! তাই আমার মতো স্বাচ্ছন্দ্যতা আনতে ভাষার গতিশীলতা বজায় রাখা যেমন জরুরী আবার বিকৃতি প্রতিরোধও জরুরী।
×