ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা কেন আমাদের ব্যবহারিক ভাষা হতে পারছে না?

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলা কেন আমাদের ব্যবহারিক ভাষা হতে পারছে না?

আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গর্ব করি। এমন দাবিও করি যে, রবীন্দ্রনাথ তার কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ায় আমাদের ভাষা বিশ্ব ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। কথাটা তাত্ত্বিকভাবে সত্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা ভাষাকে কার্যকর জাতীয় ভাষা হিসেবেও গড়ে তুলতে পারিনি। উপমহাদেশের নেটিভ খ্রীস্টানদের যেমন বলা হয় এ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তেমনি বর্তমান বাংলাদেশে সাধারণ সমাজজীবনে যে বাংলা প্রচলিত তাকে বলা চলে এ্যাংলো-বাংলা লেঙ্গোয়েজ বা বাংরেজি ভাষা। এই এ্যাংলো-বাংলা লেঙ্গোয়েজের উপর আবার হিন্দী ভাষার আধিপত্য বাড়ছে। এই আধিপত্যটা সমাজ ও সংস্কৃতিতে আরও বেশি প্রকট। ঢাকায় কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা বিবাহ-উৎসবে গেলে মনে হয় না বাংলাদেশে আছি। উৎকট হিন্দী গান ও নাচের অনুকরণ এবং বর-কনের পোশাক দেখলে বোঝা যায় আমাদের সামাজিক জীবনে অবক্ষয় কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। রাজধানীতে আমরা অনেকে ভারতীয় আধিপত্যের ভয়ে ভীত। কিন্তু সেই আধিপত্য যে অপসংস্কৃতির বেশ ধরে আমাদের সামাজিক জীবনে শর্ষের মধ্যে ভূত হয়ে বসে আছে সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে সব দেশের ভাষা সংস্কৃতির মধ্যেই একটা বড় রকমের আদান-প্রদান চলছে। তা ঠেকানো যাবে না এবং তা ঠেকানো উচিতও নয়। নয়া প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে ইংরেজী বা ফরাসী ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে উপায় নেই। রেডিও, টেলিভিশনের ইংরেজী নামের মতো বর্তমান যুগের নবপ্রযুক্তির উদ্ভাবনাগুলোর বিদেশী নামও বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে। তা বাংলা ভাষাকে উন্নত করছে। এটাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ভয় পাই বিদেশী উন্নত সংস্কৃতি নয়, অপসংস্কৃতির আধিপত্যকে এবং ভাষায় তার অশুভ অনুপ্রবেশ দেখে। আমি ভাষা বিশারদ নই; আমার ভাষাও ভুলত্রুটি মুক্ত নয়। যথাসম্ভব ভাষা-বিকৃতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু দেশের পত্রপত্রিকায় এবং নতুন কবি সাহিত্যিকদের অনেকের লেখায় এই ভাষা বিকৃতি দেখে দুঃখ পাই। এই ভাষা বিকৃতির উদাহরণ দিলাম না এ জন্য যে, যাদের লেখা থেকে উদাহরণ দেব তারা অসন্তুষ্ট হবেন। বাংলা ভাষা এখন আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং জাতীয় ভাষা। কিন্তু না আমাদের রাষ্ট্রে, না জাতীয় জীবনে তা কার্যকর হয়েছে। দেশের শিক্ষিত অংশ বিশেষ করে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা এবং উর্ধতন সরকারী অফিসারেরা এ্যাংলো-বাংলা বা বাংরেজি ভাষায় কথা বলেন, কাগজপত্রে বা ফাইলে তা লেখেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একটি কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক স্যুট বুটধারী শিক্ষিত বাঙালী দেখা করতে এসেছেন। তিনি অনবরত ইংরেজী মিশ্রিত বাংলায় কথা বললেন। তিনি চলে যেতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ভদ্র লোক ইংরেজী বাংলা কোনো ভাষাই ভালো করে শেখেননি।’ বাংলাদেশের বর্তমান অফিস-আদালতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথায় সত্যতা বোঝা যায়। অনেক উর্ধতন অফিসারও ইংরেজী ও বাংলা মিশ্রিত ভাষায় কথা বলেন, অফিস অর্ডার লেখেন, কিন্তু কোন ভাষাই ভাল করে হয় তো শেখেননি। আগের দিনের ব্যুরোক্র্যাটরা অন্তত ইংরেজটা ভালভাবে শিখতেন। একাত্তরের শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। পরে বাংলা বিভাগে চলে আসেন। ইংরেজী, বাংলা দু’ভাষাতেই তিনি ছিলেন পারদর্শী। আমার বন্ধু ড. সিরাজুর ইসলাম চৌধুরীর বাংলা প্রবন্ধ পড়ে মুগ্ধ হতে হয়। অথচ তিনি ইংরেজীর অধ্যাপক। অর্থাৎ এরা দু’জনেই ইংরেজী ও বাংলা দুটো ভাষায় ভালভাবে শিখেছেন। বর্তমানে এই উদাহরণ কম। এখন ইংরেজ শিক্ষার ওপর গুরুত্ব কমে যাওয়ায় ভাল ইংরেজী জানা মানুষের সংখ্যা কম। আবার বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার প্রচলন কার্যকর না হওয়ায় ভাল বাংলা জানা ও বলাও অনেকে প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে সমাজজীবনে যে বাংরেজি ভাষার আধিপত্য চলছে তার সম্প্রসারণ তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছলে শুধু ভাষার নয়, সমাজজীবনেরও গুরুতর অধঃপতন ঘটবে। ভাষা আন্দোলনের সব সাফল্য নষ্ট হবে। বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাহলো বাংলা ভাষাকে কেবল নামে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করে তাকে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারিক ভাষা করার ব্যবস্থা হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে আমরা প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনেও ইংরেজী ব্যবহার করি। কিন্তু ভালভাবে ইংরেজী শিক্ষাঙ্গনের ব্যবস্থা করছি না। ঢাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজী শিক্ষাভিত্তিক যে কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলো গজিয়ে উঠেছে তার অনেকগুলোতেই শিক্ষার মান কতটা উন্নত তা জানি না। যদি উন্নত হয়ে থাকে তাতে লাভ বিত্তশালী অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েদের। দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে নি¤œ শ্রেণী থেকে ইংরেজীকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমি জানি না তা করা হয়েছে কিনা। ইংরেজী না শিখলে আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক আমরা হারিয়ে ফেলব। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারব না। একই সঙ্গে বাংলাকে সমাজজীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ব্যবহারিক ভাষা করার আগে তাকে সমাজজীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বাংলা ভাষায় যদি ওষুধের একটা প্রেসক্রিপশন লেখা না যায়, কমার্শিয়াল লেটার লেখা না যায়, কূটনৈতিক চিঠিপত্র আদান-প্রদান না করা যায় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কলকাতা সফরে গেলে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক তাকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, বাংলাকে শুধু সাহিত্যের ভাষা করে রাখলে চলবে না, তাকে বিজ্ঞানের এবং জীবনের সর্বস্তরের ব্যবহারিক ভাষা করে তুলতে হবে। সেটা কেবল আপনিই পারবেন। বাংলাদেশের এখন দরকার কয়েক ডজন জগদীশ বসু ও সত্যেন বোস। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি একটা বাংলা বিজ্ঞান একাডেমি প্রতিষ্ঠা করুন।’ বঙ্গবন্ধু এই বিজ্ঞান একাডেমি প্রতিষ্ঠার সুযোগ ও সময় পাননি। ইংরেজী ভাষার ওপর সুদূর অতীতে ফরাসী ভাষায় দারুণ আধিপত্য ছিল। অভিজাত ইংরেজরা ফরাসী ভাষায় বা ফরাসী মিশ্রিত ইংরেজীতে কথা না বললে তাদের আভিজাত্য খর্ব হচ্ছে মনে করতেন। কবি-সাহিত্যিকেরাও ফরাসী মিশ্রিত ইংরেজী লিখতে পছন্দ করতেন। কবি চসারের যুগে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। চসার শুধু ইংরেজী ভাষায় নয়, ইংরেজদের সমাজজীবনেও তাদের ভাষার মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন। একই কাজটি করেছেন পারস্যে কবি ফেরদৌসী। সে সময় আরবী ভাষা গভীরভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল ফরাসী ভাষাকে। কবি ফেরদৌসী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আরবীর প্রভাবমুক্ত ফারসী ভাষায় তার মহাকাব্য লিখিতে শুরু করেন পারসিক সমাজজীবনে তাদের ভাষায় মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও গত শতকের মধ্যভাগে এই কাজটি করেছেন কবি শামসুর রাহমান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষায় অনাবশ্যকভাবে উর্দু ফারসী শব্দের ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘রূপালি স্নান’ কবিতায় ‘ঈশ্বর’ শব্দ ব্যবহার করায় সরকারী রোষে পড়েন। সরকারী পত্রপত্রিকায় তার লেখা নিষিদ্ধ হয়। এদিক থেকে কবি শামসুর রাহমানও একজন ভাষা সৈনিক। তিনি বাংলাদেশের কবি ফেরদৌসী। ২০১৯ সালের ভাষা আন্দোলনের মাসে আরেকটি ভাষা আন্দোলন শুরু করার প্রয়োজন মনে করি। সেটি ব্যবহারিক বাংলা তৈরি এবং তা সমাজের সর্বস্তরে প্রচলনের আন্দোলন। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও সমাজজীবনকে হিন্দী অপসংস্কৃতির গ্রাস থেকে মুক্ত করার সার্বিক প্রচেষ্টা। এদিকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কবি সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেই সঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করি ভাষাকন্যা (সৈয়দ শামসুল হকের দেয়া খেতাব) শেখ হাসিনার। লন্ডন, ১২ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৯
×