ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী এক অনন্য নারী

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী এক অনন্য নারী

মমতাজ বেগমের প্রকৃত নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। তিনি সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশীর বোনের মেয়ে। ১৯২৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রগতিশীল চিন্তার ধারক কল্যাণী রায় চৌধুরী রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ভালবেসে বিয়ে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর আব্দুল মান্নাফকে। ধর্মান্তরিত হয়ে কল্যাণী রায় চৌধুরী নাম গ্রহণ করেন মমতাজ বেগম। মমতাজ বেগম ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে যে অপরিসীম বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা এক অনন্য ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল পর্বে তিনি নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সকল অবগুণ্ঠন ও পর্দাপ্রথার বেড়াজাল ছিন্ন করে তিনিই প্রথম নারায়ণগঞ্জের মহিলাদের নিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথের মিছিল ও সমাবেশে শরিক হন। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে মমতাজ বেগমই প্রথম মহিলা যার আন্দোলন ও সংগ্রামে স্থানীয় প্রশাসন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে গ্রেফতার করে এক বছরের অধিক সময় কারাগারে আটক রাখেন। মমতাজ বেগম সেই তেজস্বিনী, আপোসহীন সংগ্রামী নারী যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কারাগার থেকে মুক্তির জন্য সরকারের মুচলেকায় স্বাক্ষর না করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। মমতাজ বেগমই প্রথম নারী যিনি ছিলেন দীর্ঘ সময় কারাবন্দী। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে মমতাজ বেগমই প্রথম ও একমাত্র মহিলা যাকে এ আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে সরকারী চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাকে স্বামী-সংসার হারাতে হয়েছে। শুধু ভাষাপ্রীতির কারণে নিরাপত্তাহীন, অনিশ্চিত জীবনের দুর্গম পথে একাকী চলেছেন তিনি। বাংলা ভাষার জন্য এ রকম ত্যাগের ইতিহাস এক বিরল ঘটনা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে ও সংগ্রামের স্বার্থে তিনি নিজেকে তিলে তিলে উৎসর্গ করেছেন, কোন লোভ-লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ২৯ ফেব্রুয়ারি মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় নিম্নোক্ত খবর প্রকাশিত হয়- ‘সকালবেলা স্থানীয় পুলিশ নারায়ণগঞ্জ মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করে মহকুমা হাকিমের আদালতে হাজির করে। সংবাদ পেয়ে একদল ছাত্র ও নাগরিক আদালতের সামনে হাজির হয়, বিনা শর্তে তার মুক্তি দাবি করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনি করতে থাকে। মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজী তখন বাইরে এসে বলেন, মমতাজ বেগমকে স্কুলের তহবিল তসরূপের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার গ্রেফতারের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জনতা তা বিশ্বাস করে না, বলতে থাকে, মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কর্মী বলেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। সুতরাং তাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে তারা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাবে না। পুলিশ তখন মৃদু লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। বিকেলে পুলিশ মোটরযোগে মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলে চাষাঢ়া স্টেশনের কাছে জনতা বাধা দেয়। তাতে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে উভয়পক্ষে ৪৫ জন আহত হয়।’ ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় মমতাজের গ্রেফতার সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়- ‘ঢাকা, ২৯ ফেব্রুয়ারি। অদ্য অপরাহ্নে এখান হতে ১০ মাইল দূরবর্তী নারায়ণগঞ্জে জনতার আক্রমণে প্রায় ২০ জন পুলিশের লোক আহত হয়েছে। প্রকাশ, একদল পুলিশ তহবিল তসরূপের একটি মামলায় অভিযুক্ত স্কুলের জনৈক হেড মিস্ট্রেসকে স্থানীয় আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। কর্তৃপক্ষীয় মহল হতে জানা যায়, জনতা ওই হেড মিস্ট্রেসকে ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে ধরা হয়েছে মনে করে সম্ভবত পুলিশ দলকে আক্রমণ করেছেন ও তাঁকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছে। প্রকাশ, জনতা ইট ছোড়ার সময় পুলিশ নিকটবর্তী একটি পুলিশ ফাঁড়িতে যেয়ে আশ্রয় লয়। জনতা দুই ঘণ্টাকাল ইট-পাটকেল ছোড়ে এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে গাছের গুঁড়ি ফেলে বাধা সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত পুলিশ অবিলম্বে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় এবং লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সম্পর্কে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে’ (সূত্র : দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২ মার্চ ১৯৫২) ভাষা সংগ্রামী মমতাজ বেগম জেল থেকে মুক্ত হয়ে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করে ১৯৬৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। স্মরণীয় অবদান থাকা সত্ত্বেও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। পুস্তক-পুস্তিকা ও সংবাদপত্রের পাতায় এমনকি কোন গবেষক ও লেখকের লেখায় তার অবদান তেমনভাবে উল্লেখ করা হয়নি। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার একমাত্র কন্যা শাহানা বেগম খুকুর লেখা ‘বিস্মৃত প্রায় এক ভাষাসৈনিক’ প্রবন্ধটি পরে আমি তথ্য সংগ্রহের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠি। এর বছরখানেক পূর্বেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল শাহানা বেগম খুকুর সঙ্গে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার আমন্ত্রণ ও অনুরোধে তিনি ভাষা-আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে আসেন এবং মমতাজ বেগমের তথ্য সংবলিত একটি ফাইল প্রদান করেন জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য। ওই ফাইলে তেমন কোন তথ্য ছিল না। মমতাজ বেগমের মৃত্যুর ৪৪ বছর পর তাকে নিয়ে গবেষণামূলক কাজ ও তথ্যসংগ্রহ করা কঠিন জেনেও আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশের উদ্যোগ নেই। ৩ বছরের শ্রমে ঢাকা ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের লেখা নিয়ে আমার সম্পাদনায় ২০১১ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এতকাল পরে হলেও মমতাজ বেগমকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের পর তাকে জানা ও বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়। একুশে পদকপ্রাপ্তির জন্য সরকারের কাছে আমরা আবেদন করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালে মমতাজ বেগমকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। তাছাড়া ২০১০ সালে ভাষা-আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের পক্ষ থেকে মর্গান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাটি ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’ নামকরণের জন্য নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী বরাবর আবেদন দাখিল করি। মাননীয় মেয়র আমাদের আবেদন সুবিবেচনা করে ২০১০ সালে ৮ আগস্ট রাস্তাটি শুভ উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের নাগরিক কমিটির আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের জনগণ। ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগমের স্মৃতি সংরক্ষণ ও গবেষণাকর্মে যাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয় তারা হলেন- নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, সভাপতি এবি সিদ্দিক, সহ-সভাপতি, সাংস্কৃতিক সংগঠক রফিউর রাব্বি, সাংবাদিক রুমন রেজা প্রমুখ। উপেক্ষিত ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগমকে নিয়ে বই প্রকাশ, একুশে পদকপ্রাপ্তি এবং সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে ভাষা-আন্দোলনের অজানা উপেক্ষিত একটি অধ্যায় নতুন করে আলোর মুখ দেখতে পেল বলে আমাদের ধারণা। লেখক : গবেষক, নির্বাহী পরিচালক গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর
×