ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোঃ নূরুল্লাহ্

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ॥ রাশেদ সোহরাওয়ার্দী

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ॥ রাশেদ সোহরাওয়ার্দী

গণতন্ত্রের মানসপুত্র ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দী (৭৯) গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ প্রয়াত হন। তাঁর প্রয়াণে দেশপ্রেমিক বাঙালী মাত্রই শোকাভিভূত। তাঁর বাবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৬-৪৭ সালে যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে ১৯৫৬-৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আমার দেখা হয় কয়েক বছর আগে পূর্ব লন্ডনের ওয়াটার লিলি সেন্টারের এক অনুষ্ঠানে। লন্ডনে বাংলাদেশের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার আল্লামা সিদ্দিকী তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। সেখানে আরও দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহনার সুযোগ্য কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকীর (বর্তমানে হাউস অব কমন্স-এর সম্মানিত এমপি) সঙ্গে। টিউলিপের ভাই-বোনরা ছোটকালে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে ডাকতেন ‘ইংরেজ মামা’ বলে। রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর মা ভেরা আলেক জানড্রোভনা ছিলেন রাশিয়ান এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী। তাই তাঁকে দেখতে ইংরেজ বা ইউরোপিয়ানদের মতো দেখাত। ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত সদস্যদের বিলেতে হাতেগোনা যে কয়জন শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন এবং নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখতেন রাশেদ সোহরাওয়ার্দী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাবার রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট না হয়ে মায়ের মতো অভিনয়কেই জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক চক্র সোহরাওয়ার্দী কন্যা বেগম আখতার সোলায়মানকে আরও কিছু বাঙালীসহ বিলেতে পাঠায় পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালাবার জন্য। ২০ জুলাই বেগম আখতার সোলায়মান তার স্বামী শাহ আহমেদ সোলায়মানসহ লন্ডন এসে হাজির হন। লন্ডনে তার বক্তব্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানের যে যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তা গৃহযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর আগে জুন মাসে বেগম আখতার সোলায়ামান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যাকে সমর্থন করে একটি বিবৃতি দেন এবং বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন তার বাবা শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতেন। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ মান্নান বেগম সোলায়মানের বিষয়টি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে বলেন, বিচারপতি চৌধুরী সব শুনে বলেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বিলেতে থাকেন। তাঁর সন্ধান কে দিতে পারবে? সেক্সপিয়য়ের জন্মস্থান খ্যাত বার্মিংহামের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন এভন এ ‘কাশ্মীর রেস্তরাঁর’ বাঙালী মালিক আরব আলীর সঙ্গে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী আলাপ পরিচয় ছিল। রয়েল সেক্সপিয়র থিয়েটারের সদস্য হিসেবে তখন রাশেদ সোহরাওয়ার্দী স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন এভনে থাকতেন। মাঝে মাঝে আরব আলীর রেস্তরাঁয় খেতে এলে আলাপ পরিচয় হয়। এ আরব আলীই অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজের গাড়িতে করে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে স্টিয়ারিং কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় লন্ডনে গোরিংস্ট্রিটে (অধুনালুপ্ত) নিয়ে আসেন। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী শেখ মান্নানসহ তখন অফিসে উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী এককালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তার সূত্র ধরে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ‘ মি. সোহরাওয়ার্দী, আপনার পিতা আমাকে স্নেহ করতেন। তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসতেন। বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন। এ জন্য তাঁকে অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে নিজের লোকজনের প্রতি আপনার কিছু কর্তব্য আছে?’ রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ‘হ্যা’ সূচক জবাব দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু আমি কি করতে পারি?’ তখন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী বলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশ সমর্থন করেন তা তাহলে বেগম সোলায়মানের বিবৃতির প্রতিবাদ করতে পারেন।’ এ কথা শুনে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, তিনি অবশ্যই বাংলাদেশকে সমর্থন করেন। তবে তিনি চান বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে। তখন শিক্ষিত সমাজের অনেকেই সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতো। যা হোক, বিচারপতি চৌধুরী তাঁকে তখন বলেন, বাংলাদেশ আপনার নিজের দেশ। আপনি কি চান তা আপনি স্থির করুন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার একটি ‘সমাজতন্ত্র’ তা স্মরণ করিয়ে দেন। এ কথার পর রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ‘মুজিব নগর’ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে একটি পত্র লেখেন এবং পত্রের বক্তব্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ৭ অক্টোবর, ১৯৭১-এর লিখিত পত্রে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেন: ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে গণহত্যা শুরু হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের মুক্তি সংগ্রামের দৃঢ় সমর্থক। রাজনীতিতে জড়িত না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাগে বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য (বেগম আখতার সোলায়মান) তার বিবৃতির মাধ্যমে আমার প্রিয় পিতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন বলে বুঝতে পারার পর আমার বক্তব্য পেশ করা অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বিজয় আমি কামনা করি। গত ২৪ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ করে এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে কর্তৃত্বাধীনে রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী গণহত্যা এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধজনক কর্মকা- শুরু করায় পর তারা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা আক্রমণকারী সৈন্যদের উৎখাত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে, এ সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ, আমি আশা করি অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে গিয়ে দেখব- বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা শান্তি ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সরকারকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সরকারের সদস্যবৃন্দের সবাই আমার পিতার সহকর্মী এবং স্নেহের পাত্র ছিলেন।’ ১৯৭১ সালে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর এ বিবৃতি মুজিব নগর সরকারসহ সব দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীকে অনুপ্রাণিত করে। রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর প্রয়াণে আজ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। লেখক : লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির এ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স ও ইনফরমেটিক্স ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান
×