ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসমত আরা জুলী

মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও এগিয়ে চলা ॥ তরুণ প্রজন্মের ভাবনা

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও এগিয়ে চলা ॥ তরুণ প্রজন্মের ভাবনা

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম নারী কবিতায় (১৯২৫) যদিও ঘোষণা করছেন, ‘সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।’ তারপরও সমাজে রয়ে গেছে নারী-পরুষ বিভাজনের সেই অমোঘ ধারা যা পরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে অযৌক্তিক বিধি নিষেধের জালে আটকে রাখার প্রক্রিয়াকে জোরদার করেছে যুগের পর যুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে (১৮২৯ সালে) রামমোহন রায় ও তাঁর সহযোগীদের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পর আরও অনেক সামাজিক প্রথা নারীকে অবহেলিত, অসম্মানিত এবং অবরোধবাসিনী করার সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে দীর্ঘ দুই শতক ধরে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ও পরুষতান্তিক সমাজব্যবস্থার জটিল সমীকরণে পড়ে নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতা, বাধাগ্রস্ত ও পরাধীন। নারীবাদী লেখক ও সমাজসংস্কারক বেগম রোকেয়া তাঁর কল্পকাহিনী ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯০৫) এ দেখিয়েছন পুরুষেরা নীরবে ঘরে কাজ করছে আর মেয়েরা কাজ করছে বাইরে; ফলে দেশের কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে না। এটি ছিল তাঁর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি সরাসরি আঘাত এবং নারীর অসাধারণ ক্ষমতার জায়গান। বেগম রোকেয়ার ‘পদ্মারাগ’ (১৯২৪) উপন্যাসের নায়িকা সিদ্দিকা বলেছেÑ একাত্র বিবাহিত জীবনই নারীজন্মের চরম লক্ষ্য নয়, সংসার ধর্মই জীবনের সারধর্ম নয়। চার দেয়ালের বাইরে যে নারীর অবস্থান অর্থপূর্ণ হতে পারে তা তিনি একজন নারীবাদী ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বাবলম্বী হওয়া, সামাজিক বিধিনিষেধ, নেতৃত্ব, গণপরিবহনে কিংবা হাঁটাচলার পথে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া- এসব নিয়ে এখনকার তরুণ শিক্ষার্থীরা কি ভাবছে, তাদের ভাবনার জগতটাকে আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে সেসব প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলাম এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের উত্তরা ক্যাম্পাসে কিছু মেয়ে শিক্ষার্থীর। তারা বলেছে তাদের ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা। কথা বলেছি বাংলা বিভাগের নিপা, তৃষা চাকমা, এমবিএর সানজীদা, অর্থনীতির সাবিকুন্নাহার, ইংরেজী বিভাগের কেয়া, জান্নাতুল ¯েœহা,বিবিএর রূপা ও তানজীনার সঙ্গে। নিপা ও তৃষা চাকমা উচ্চশিক্ষায় বাংলাকে বেছে নিয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গভীরভাবে ভালবেসে এবং তাদের ইচ্ছা পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা কিংবা সরকারী চাকরিতে যোগ দেয়া। নিপার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় সামাজিক বাধা এসেছে আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর মাধ্যমে যারা মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত না করে বিয়ে দেয়াকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে আর তৃষ্ণা চামকা বলেছে তাদের (নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর) সমাজে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলো মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। সমাজের প্রভাবশালী লোকজন তাদের বলে যে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেই পরিবারের জন্য ভাল হয়। তবে তাদের সমাজে এখন মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তৃষ্ণা চামকা যদিও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী থেকে আগত একটি মেয়ে কিন্তু সে নিজেকে আলাদা মনে না এবং নিজেকে বাংলাদেশের মূল সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্তা করতে পেরেছে বলে সে মনে করে। একজন বাংলাদেশী হিসেবেও সে গর্বিত। উচ্চশিক্ষায়, চাকরিতে এবং নেতৃত্বে নারীরা এগিয়ে এলে নারী নির্যাতন একেবারে কমে যাবে বলে নিপা মনে করে। ওরা দুজন গণপরিবহনে চলাচলের সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। নিপা বলল, গণপরিবহনে মধ্যবসয়সী পরুষ যাত্রীরা মেয়েদের বিরূপ মন্তব্য করে। এ রকম অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মনে হয় নারী স্বাধীনতা ব্যাপারটি এখনও সুদূর পরাহত। তৃষা পার্বত্য অঞ্চলের মেয়ে বলে তাকে মাঝে মধ্যে পথে-ঘাটে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়; বলাবাহুল্য যে, এসব পরিস্থিতির স্রষ্টা হচ্ছে পরুষেরা যারা ইভটিজিংকে কোন অপরাধ বলে মনে করে না। তার মতে মেয়েদের জন্য অনেক বেশিসংখ্যক বাস চালু করে ছেলেদের যাতায়াতের প্রতিদিনের সমস্যা দূর করা সম্ভব কিন্তু মনমানসিকতার আমূল পরিবর্তন ছাড়া ছেলেদের আচরণ পরিবর্তন করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার। নিপা মনে করে নারী নেতৃত্ব সমাজকে বদলে দিতে পারে, তাই মেয়েদের প্রতি ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়া সম্ভব। মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কঠোর আইন এবং আইনের প্রয়োগ জরুরী বলে সে মনে করে। তৃষা মনে করে প্রতিটি মেয়েকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে রাখতে হবে এবং নিজেকে শুধু নারী হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এজন্য নারীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা খুবই প্রয়োজন। এরা দুজনই নিজেদের প্রথমত মানুষ ভাবে এবং এরপর নারী অস্তিত্বকে অনুভব করে। কারণ মানুষ হিসেবে ভাবলে বাঁধাধরা নিয়মকানুনের শেকলে নিজেকে বন্দী করতে হবে না এবং নারীর নির্দিষ্ট বৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে এসে মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব সবই করতে পারবে। সানজীদা ও সাবিকুন্নাহার পরিবারের উৎসাহে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। সানজীদা এমবিএ পড়ছে এবং ভবিষ্যতে সে কোন দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে এইচ আর এ কাজ করতে আগ্রহী। আর সাবিকুন্নহার পড়ছে অর্থনীতিতে এবং ভবিষ্যতে সে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়। তাদের দুজনের মতে দেশের অর্থনীতিতে নারীরা সম্পৃক্ত হলে এর প্রভাব নিশ্চিতভাবে পড়বে পরিবার এবং সমাজের উপর। মেয়েদের নিজেদের আলাদা পরিচয় দরকার এবং একই সঙ্গে দরকার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। ওদের দুজন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ঘরে বসে থাকবে। এ কথা কল্পনা করতে পারে না। নারী নেতৃত্বের ব্যাপারে তাদের অভিমত হলো নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। সাবিকুন্নাহার গণপরিবহনে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সে বলেছে গণপরিবহনে চলাচলের সময় প্রায়শ পরুষ যাত্রীরা মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে এবং হাত দেয়। সে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায় না, নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে এবং পরিবারের সদস্যদের নিরপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে। এ পিরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মেয়েদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন বলে সে মনে করে, এখন যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদিও সমাজ ওদের প্রতিনিয়তই মনে করিয়ে দেয় যে ওরা মেয়ে কিন্তু দুজনেই নিজেদের প্রথমে মানুষ হিসেবে ভাবতে চায়, ভাবতে চায় না যে মেয়ে বলে অনেক কিছু তারা করতে পারবে না। তারা ভাবে মানুষ হিসেবে যেন তারা এগিয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতের পথে।
×