ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বই ॥ জন্মান্তর

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বই ॥ জন্মান্তর

মাহবুবর রহমানের ‘জন্মান্তর’ গল্প সঙ্কলনটি প্রকাশ পায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এ। প্রকাশ করে দাঁড়কাক। প্রচ্ছদ আঁকেন সঞ্জীব পুরোহিত। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পাওয়া এই বইটি বাংলাদেশের সামাজিক প্রতিবেশের এক সচিত্র প্রতিবেদন। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনায় সিক্ত যাপিত জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো যে মাত্রায় শৈল্পিক শৈলীতে ঋদ্ধ হয় সেখানে গ্রন্থের রূপকার একজন যথার্থ নির্মাতার ভূমিকায় নিজেকে অনবদ্য করে তোলেন। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্পর্শকাতর অনুভব, আবহমান বাংলার চিরায়িত প্রাকৃতিক বৈভব সঙ্গে নদী বিধৌত পলিমাটির নমনীয় ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষকে উপজীব্য করে গল্পের যে কাহিনী সম্ভার তার গতি নির্ণয় করে তা শুধু নান্দনিক আবহে সিদ্ধই নয় কঠিন বাস্তব জীবনের নির্মম কষাঘাতের এক করুণ আখ্যানও বটে। আর তাই শিল্পরসে সমৃদ্ধ গল্পগুলোর বেদনাবিধুর ঘটনা পরম্পরায় পাঠকের হৃদয়ের গভীরে কড়া নাড়ে, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের টানাপোড়েন ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে বিভিন্ন গল্পের যথার্থ নির্ণায়কের ভূমিকায়। আর তাই প্রতিটি গল্পের প্রধান চরিত্র যেমন লেখকের সাবলীলতায় নিজস্ব গতি নির্ধারণ করে পাশাপাশি কাহিনীর মূল সারবত্তাও অনবদ্য হয়ে ওঠে। গল্পগুলো শুধু গ্রাম বাংলার নির্মল নৈসর্গিক সম্ভারের প্রস্ফুটিত প্রতিচ্ছবিই নয় বরং দেশাত্মবোধের এক অজেয় মনোবলে স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তস্নাত পথপরিক্রমার বিক্ষুব্ধ আবহের বাস্তব চিত্রও। সেখানে অসংখ্য মানুষের প্রাণসংহার থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণই শুধু নয় হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার ক্ষতবিক্ষত অভিযাত্রা ও গল্পের গতি সংহত করে, নির্ধারিত পরিণতিতে শেষও হয়। শুরুতেই গল্প কথক চিকিৎসকের ভূমিকায় নিজের বয়ান পাঠকের সামনে হাজির করে সুস্থ ও অসুস্থ জীবনের প্রয়োজনীয় পর্যায়গুলো অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেন। ‘জন্মান্তর’ গল্পগুচ্ছের প্রথম ঘটনা বিন্যাস ‘জন্মান্তর‘ হৃদরোগে আক্রান্ত তাবাসসুমের শারীরিক অসুস্থতার আবর্তে পড়া এক উদীয়মান, টগবগে যুবতীর মনোবেদনার ভারাক্রান্ত আখ্যান। গল্পের বিষয়বস্তুতে দৃশ্যমান হয় নায়ক রিয়াজ একজন চিত্র শিল্প নির্মাতা। শুধু তাই নয় গল্পের রূপকার নিজেও শিল্পানুরাগী এক চিকিৎসক যে কিনা ভ্যান গগের গুণমুগ্ধ। যে মনস্তাত্ত্বিক ও শৈল্পিক বোধে রিয়াজের সঙ্গে সখ্যতা। কিন্তু রিয়াজের স্ত্রীর চিকিৎসায় তিনি একজন অভিজ্ঞ, নীতিনিষ্ঠ ডাক্তার। গল্পের কাহিনী করুণ রসাত্মকে মোড় নিতেও সময় লাগেনি যখন অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে তাবাসসুম চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। মানুষ মরণশীল। এই চিরায়ত চূড়ান্ত সত্যকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া যায় ততই মঙ্গল শুধু নিজের জন্যই নয়, অন্যের বেলায়ও। ‘অনন্ত যাত্রা’ গল্পটিও অতি সাধারণ মা ও ছেলের মর্মস্পর্শী দুঃখভারাক্রান্ত কাহিনী। দীনহীন অনন্ত এবং তার মা সমাজের বিত্তবান দ্বারা প্রতিনিয়তই লাঞ্ছিত এবং অত্যাচারিত। বেদনাসিক্ত জীবনের বৈতরণীর শেষ পরিণতিও কোনভাবেই সুখকর ছিল না। স্বামী হারা অনন্তের মা কোনমতে তার শেষ সম্বল পুত্রটিকে নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করত। কিন্তু ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সেই বিপর্যস্ত জীবনকে আরও অসহনীয় করে তোলে। গ্রন্থের রূপকার যে মাত্রায় স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাক হানাদার বাহিনী, দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মমতার ঘটনা বিধৃত করেন তা যেমন নৃশংস, মানবতাবিবর্জিত একইভাবে দেশাত্মবোধের এক অনন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষের জীবননাশ, তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা, দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং নারী নিগ্রহের যে মর্মান্তিক অমানবিক ঘটনার অশুভ সঙ্কেত সারা বাংলাকে কাঁপিয়ে দেয় সে সব কাহিনীও লেখকের শৈল্পিক সুষমাকে তাড়িত করে, মনুষ্যত্বের চরম অপমান নন্দনতত্ত্বের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে শেষ অবধি নারীত্বের অসম্মান গল্পের গতি নির্ধারণে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। গতিময় জীবনের আনন্দ-বিষাদে পরিপূর্ণ গল্পগুলো বাস্তব প্রেক্ষাপটের এক অনবদ্য শৈল্পিক রূপকল্প যা লেখকের নান্দনিক শৌর্যকে নানামাত্রিকে উজ্জীবিত করে। গল্পগুলো পাঠকপ্রিয়তা পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×