ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাকিদ হায়দার

আত্মজৈবনিক ॥ কি যেন হারিয়ে এলাম ॥

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আত্মজৈবনিক ॥ কি যেন হারিয়ে এলাম ॥

পূর্ব প্রকাশের পর আমার মামাদের বাড়ি জিন্নাপার্ক সংলগ্ন কেষ্টপুর মহল্লায়। এই কেষ্টপুর এবং এরই দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মহল্লার নাম আটুয়া, এই দুই মহল্লার লোকজনদের দেখে, শহরের অন্যান্য মহল্লার লোকদের ভেতরে সব সময়ই এক ধরনের ভীতি কাজ করতো। বিশেষত বাণী সিনেমা হলে যদি কোন ভালো হিন্দি, উর্দু কিংবা বাংলা সিনেমা আসতো তখন ঐ দুই পাড়ার তরুণ টিকিট ব্ল্যাকারদের কাছে বাণী সিনেমা হলের পুরো এলাকাটি হয়ে যেতো স্বর্গরাজ্য, সাড়ে আট আনার টিকিট বিক্রি হতো এক, দেড়-দুই টাকায়। বিশেষত হিন্দি ছবিতে যদি দিলীপ কুমার, মধুবালা, বাংলা ছবিতে সুচিত্রা, উত্তম এবং উর্দু ছবিতে জেবা, কামাল সন্তোষ, সাবিহা ঐ সকল অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনীত ছবি যদি বাণী সিনেমায় আসতো তাহলে কেষ্টপুর, আঠুয়ার, তরুণ ব্ল্যাকারদের ধর্ণা দিতে হতো, আমাদের সহপাঠী হারুদাসের কাছে, সে যেন তার বাবাকে বলে দেয়, বলে দিলে ব্ল্যাকারদেরকে টিকিট পেতে সুবিধে হয়। বাণী সিনেমা হলের পুরো চত্বরই দখলে থাকতো আমার মামাদের পাড়ার তরুণদের হাতে। শহরের উত্তর দিকে এডওয়ার্ড কলেজের পশ্চিম দিকের যুগীপাড়া, রাধানগর, পৈলানপুরের তরুণ ব্ল্যাকারদের দখলে থাকতো মোশারফ হোসেনের রূপকথা সিনেমা হল। এই দুই সিনেমা হলের মালিকদের ভেতরে ব্যবসাভিত্তিক এক ধরনের রেষারেষি ছিল, কে কত ভাল সিনেমা এনে দর্শকদের দেখাতে পারেন। যদি ইউনুস সাহেব এই সপ্তাহে তার বাণী সিনেমা হলের জন্য দীলিপ কুমার, মীনাকুমারী অভিনীত একটি ভালো হিন্দী ছবি আনতো, দেখা গেলো পরের সপ্তাহেই মোকারর সাহেব সুচিত্রা উত্তম অভিনীত একটি ভালো ছবি এনেছেন পাবনা শহরের সুধী দর্শকদের জন্য। কিন্তু সব সময়ই ভালো ছবি যে বাজার পাবে তার নিশ্চয়তা না থাকায় একবার বাণী সিনেমা হলে মালিক ইউনুস সাহেব তার সিনেমা হলে নিয়ে এলেন ‘নিলু’ অভিনীত ‘খাইবার মেল’ নামক এক সিনেমা, লোকেলোকারণ্য, ব্ল্যাকেও টিকিট পাওয়া যায় না আট আনা টিকিট ২ টাকাতেও পাওয়া মুশকিল। সেই ‘খাইবার মেল’ নামক সিনেমার চাহিদার কারণ দর্শকদের কাছে একটিই ছিলো, অভিনেত্রী ‘নিলু’ তিনি তার উন্নত বক্ষ দিয়ে একটি চলন্ত ট্রেন, অর্থাৎ পাকিস্তানের ‘খাইবার’ গিরিপথের দিক থেকে আগত ‘খাইবার মেল’ নামক ট্রেনটিকে, নীলু তার বুকের ধাক্কায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আর ঐ সিনেমায় ছিলো একজন কৌতুক অভিনেতা, তার নাম ছিলো শেরেগুল। শেরেগুল যখন কলা খেতেন তখন তার মাথা সমস্ত চুল দাঁড়িয়ে যেত, এরকমের হাসির দৃশ্য দেখার জন্য বাণী সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকাররা টিকিট কাউন্টার খুলবার অনেক আগেই গিয়ে লম্বা লাইন দিতো এবং মাঝে মাঝে লাইন ভেঙ্গে তারা মারামারি করতো অন্য নতুন টিকিট ক্রেতাদের সঙ্গে। তখনকার দিনে মারামারির অস্ত্র ছিলো ১০ পয়সা দামের ‘ট্রিট ব্লেড’, বড়জোর চাকু, চাকু মারামারির চেয়ে কেষ্টপুরের তরুণ ব্ল্যাকারদের প্রিয় ছিলো ব্লেড। সেই ব্লেড দিয়েই এক ব্ল্যাকার দোগাছি, সুজানগর থেকে আগত এক সিনেমা দর্শকের বাম হতে মাঝামাঝি লম্বা টান দিয়ে কেটে দিয়েছিলো, যাতে ঐ দোগাছি বা সুজানগর অঞ্চলের দর্শক ‘খাইবার মেলের’ টিকিট না কাটতে পারে, না কিনতে পারে। দর্শক লোকটির চিৎকার সিনেমা হলে কর্মরত আমার বাবা, যেহেতু তিনি ম্যানেজার, আর আমাদের শামসুলের বাবা বাবুজান কাকা, প্রায় দৌড়াদৌড়ি করে দোতলা থেকে নেমে এসে, আহত দর্শককে আইওডিন, টিংচান লাগিয়ে এবং বিনা পয়সায় ১৪ আনা দামের টিকিটের সিটে বসিয়ে বাবা আর বাবু কাকা সেই খাইবার মেল, সিনেমাটি দেখিয়ে বিদায় করছে গতকাল সন্ধ্যায়। লোকটি ম্যাটিনি শো দেখতে এসেই কেষ্টপুরের ব্ল্যাকারদের হাতে বেচারাকে ব্লেড খেতে হলো। আমদেরকে বলেছিলেন হারুদাস। ক্লাসে এসেই হারুদাস, গত কালকের ঘটনার একের পর এক যখন বর্ণনা দিচ্ছিল, ঠিক তখনি ক্লাস ফোরের ক্লাস রুমের দিকে তাকিয়ে দেখি শামসুল হক শামু, মাথা ভর্তি তেল মাখিয়ে, সুন্দর হলুদ রঙের একটি শার্ট পরে কোনদিকে না তাকিয়ে যখন সে তার ক্লাসের দোর গোড়ায়, তখন হারুদাস বললো, বুঝলি মাকিদ আর যদি না বুঝিস, তাহলে ঐ সামসুলকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস কর, কথাটি কি সত্যিই বললাম, না মিথ্যা বললাম। তবে খাইবার মেল সিনেমার শেরেগুল কলা খাবার পরপরই তার চুল খাড়া হয়ে যায়, আর নায়িকা নীলু তার বুক দিয়ে ঠেলেই উল্টোদিকে পাঠিয়ে দেয় খাইবার মেল ট্রেনটি। বিশ্বাস না হয় শামসুলকে ডেকে জিজ্ঞেস কর মিথ্যে বললাম না সত্যি বললাম। হারুদাসের অভ্যাস ছিলো, একই কথা পুনরাবৃত্তি করা, জানি না এখনো আছে কিনা। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার আগেই পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হতো, হিন্দু মসুলমান ছাত্রদের নিকট থেকে চাঁদা নিয়ে। তবে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হতো স্কুলের ফান্ড থেকে। কখনো প্রধান অতিথি আসতেন এসডিও সাহেবের অনুপস্থিতিতে আসতেন পাবনা সদর হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার সিভিল সার্জন সাহেব। দুর্গাপূজার ছুটি, রোজার ঈদের ছুটি, লক্ষ্মীপূজার ছুটি, কোরবানীর ছুটি, সরস্বতী পূজার ছুটি এ ছাড়াও আন্তঃস্কুল ফুটবল খেলায় যেবার জিসিআই স্কুল জিততো, সেবার দুই একদিন ছুটি দিয়ে দিতেন স্কুলের হেড স্যার কিম্বা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও প্রতিবছর রবীন্দ্র নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে হৈ চৈ পড়ে যেত স্কুলের হিন্দু স্যারদের ভেতরে। যে কোন শিল্প সাহিত্যের প্রধান ভূমিকা রাখতেন বিমল স্যার, অপূর্ব গোস্বামী, আবদুর রহমান স্যার। মিলাদ মাহফিলে থাকতেন মহিউদ্দিন মৌলানা আর রাজী মৌলানা এবং মোজাহার স্যার। এছাড়া আরও জনাকয়েক স্যার। আব্দুর রহমান স্যারের বাড়ি শামসুল হকদের পাড়াতেই পাবনা সদর হাসপাতালের পশ্চিম দিকের বনমালী ইনস্টিটিউটের উত্তর দিকেই, তিনি একবার রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে আমাকে আবৃত্তি করতে গিয়েছিলেন নজরুলের লিচুচোর আর শামসুল হক শামুকে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের তালগাছ নামের কবিতাটি আবৃত্তি করতে। শামুর দুর্ভাগ্য, সেই আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আমি লিচুচোর কবিতাটি আবৃত্তি করে হয় পুরস্কার পেলেও শামু কিছুই পায়নি, পায়নি আরও অনেকেই, তবে সান্ত¦না পুরস্কার হিসেবে বিমল স্যার একটি কবিতার বই শামুকে দিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটির উচ্চারণ মার্জিত তাই তাকে আমার পক্ষ থেকে এই বইটি দিলাম, এখনো মনে আছে, সেই বইটির নাম ছিলো রবি ঠাকুরের ‘খাপছড়া’ নামের একটি ছড়ার বই। আর আমাকে দিয়েছিলেন, এসডিও সাহেব, নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ এবং রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’। হিন্দু ধর্মীয় মতে সরস্বতী দেবী, বিদ্যা ও কলার অধিষ্টাত্রী দেবী, সেই সরস্বতী দেবীর পূজা উপলক্ষে প্রতিবছরই দুর্গাপূজা ও লক্ষ্মীপূজার পরেই আমাদের গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে খুবই জাঁকজমভাবেই উদযাপিত হতো সবস্বতী পূজা। হিন্দু, মুসলমান এমনকি দুই তিনজন খ্রীস্টান ছেলেও তারা খুবই আনন্দের সঙ্গে চাঁদা দিতো। আমরা মুসলমান ছাত্ররাও দিতাম বিদ্যা ও কলার অধিষ্টাত্রী সরস্বতীকে খুশী করার জন্য, তিনি যেন আমাদেরকে বর দেন, আমরা যেন সকলেই লেখাপড়া শিখে-জজ, ব্যারিস্টার পুলিশ হতে পারি। বিদ্যার দেবী প্রতি বছরই আমাদের দেয়া চাঁদার ফুল, চন্দন, নতুন কাপড় গ্রহণ করলেও দেবী মাঝে মাঝে বর দিতে ভুলে যেতেন। সেবার যেমন আমার সহপাঠী হারুদাস, জহর ঘোষ এবং গোপাল ঘোষ, চর আশুতোষপুরের দলিল উদ্দিন সরদার, আটুয়ার এরশাদ আলীকে বর দিতে ভুলে গিয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে ভুলে গিয়েছিলেন দেবী বর দিতে শামসুল হক শামুকেও। (চলবে)
×