ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক জহুরুল আলম

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

মাতৃভাষা সংগ্রামের শুরু ॥ শেখ মুজিবের ভূমিকা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতির সুদীর্ঘ সংগ্রামের একটি যুক্তিসঙ্গত পরিণতি। মুক্তির এবং স্বাধীনতার জন্য জাতির সংগ্রামে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯৪৭ সাল বা তারও বহু আগে থেকেই বাঙালীর ছোট-বড় অনেক আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলোই একত্রিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সময় বহুমাত্রিকতার আবহ থেকে একমাত্রিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেমনভাবে ১৯৭১ সালের নয় মাসের কাঠামোর ভেতরে আবদ্ধ করা যায় না ঠিক সেভাবেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কেবল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলী, এমনকি কেবল পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী বিদ্বেষ, বিভেদ ও অনাচারের ইতিবৃত্ত নয়। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বাঙালী জাতির বহু যুগের সংগ্রামের এবং সেই সঙ্গে ভাষার উত্তরণ ও জাতির গর্বের ইতিহাস যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করে যাবে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। পাকিস্তানী শাসকদের ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অভাব ও সর্বোপরি পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে পূর্ব বাংলার প্রতি ধারাবাহিক বিমাতাসুলভ আচরণ, যা মুসলিম লীগের এবং পাকিস্তানের নীতির মূল উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তা এ দেশের মানুষের চেতনাকে তথাকথিত ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের’ মিথ থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান আন্দোলনে এ দেশের আপামর জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের গঠনমূলক ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু পাকিস্তান গঠনের পর পরই এ দেশের ছাত্র, জনতা ও রাজনীতিবিদরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিমাতাসুলভ আচরণের ফলে ভালভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হলেন যে তাদের এই সমর্থন ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল। বাঙালীর ওপর প্রথম আঘাতটি আসে তার মাতৃভাষার অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এ ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে তরুণ শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালেই রচিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা ইশতেহার’ যা ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার’ নামে পরিচিতি পায়। এই প্রথম দলিলটি প্রণয়ন করে এর সমর্থনে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হতে থাকে। বাংলার মানুষের ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্র সমাজকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি তরুণ মুজিবের কাছে একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান হয়। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও ঐকান্তিক পরিশ্রমে গঠিত হয় ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে বাংলার মানুষের প্রতিটি অধিকার আদায়ে এই সংগঠনটির ধারাবাহিক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এ দেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে দশটি দাবি উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি ছিল অন্যতম। এ সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা একটি সময়ের দাবি হিসেবে সামনে চলে আসে। ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য শেখ মুজিবের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ফজলুল হক হলে একটি যৌথ সভা আয়েজিত হয় ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। শেখ মুজিবের প্রস্তাবানুযায়ী এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের। যেহেতু ছাত্র সমাজই এই আন্দোলনের পুরোধা ও মূল চালিকাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় সেহেতু ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যাপক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রাবাসের কমিটি থেকে ন্যূনতম দু’জন করে প্রতিনিধি রাখার ব্যাবস্থা করা হয়। এই ঐক্য প্রক্রিয় ছিল একটি সুদূরপ্রসারী সংগ্রামের পরিকল্পিত সূচনা, যা বাস্তবায়িত হতে থাকে তরুণ মুজিবের প্রগ্গা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে। এর পর থেকে ভাষা আন্দোলন ক্রমশই বেগবান হতে থাকে। নবগঠিত ও নবশক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ দাবি আদায়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে হরতাল আহ্বান করে। হরতাল যথাসময়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় ও সারা বাংলায় ব্যাপক গণসমর্থন লাভে সমর্থ হয়। এ দিন শেখ মুজিব জঘন্য পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন এবং এক পর্যায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ও বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৩ মার্চ ঢাকায় পুনরায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় ও ১৪ মার্চ সারা বাংলায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। ঐতিহাসিক ৮ দফা চুক্তির অন্যতম দুটি দফা ছিল, রাজবন্দীদের মুক্তি ও বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের সর্বপ্রথম বিজয়, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র বাধ্য হয়েছিল জনতার শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে। পরবর্তী ইতিহাস অবশ্য পাকিস্তানী শাসকগণকর্তৃক চুক্তি ভঙ্গের ইতিহাস যার মূল নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন মি. জিন্নাহ ও খাজা নাজিমুদ্দীন। চুক্তির শর্তানুযায়ী শেখ মুজিবসহ অন্যান্য বন্দীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এরপর থেকে শেখ মুজিবকে বিশেষ নজরে রাখতে শুরু করে ও শেখ মুজিবের গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্যাদি নিয়মিত মনিটরিং করতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীদের কাছে স্পষ্টতই শেখ মুজিবের বাংলার স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন মনোভাব পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে প্রতীয়মান হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকান্ডের আগেই তাই শেখ মুজিবকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল পুনর্বার। এক পর্যায়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের অজুহাতে ছাত্রত্বও বাতিল করে দেয়া হয়, যাতে করে তার পক্ষে ছাত্র রাজনীতিতে বিশেষত ভাষা আন্দোলনে তার নেতৃত্ব প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শেখ মুজিবকে ছাত্র আন্দোলনসহ কোন গণআন্দোলন থেকেই বিরত রাখা পাকিস্তানীদের পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হয়নি। খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি অনুযায়ী মুক্তি পাওয়ার পরদিনই, অর্থাৎ ১৬ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। তার নেতৃত্বে একটি জঙ্গী মিছিল গণপরিষদ অভিমুখে রওনা হয় ও পথিমধ্যে পুলিশী বাধার সম্মুখীন হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৭ মার্চ আবার বটতলায় ছাত্রলীগের সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে মুজিব, তাজউদ্দীন, তোয়াহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকে শেখ মুজিবকে ধারাবাহিকভাবে বহুবার কারান্তরালে পাঠানো হতে থাকে। কিন্তু কারান্তরালে থেকেও মুজিবের চিরকুটে পাঠানো নির্দেশাবলী বাইরের সংগ্রামী ছাত্র-জনতার সংগ্রামের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে যেতে থাকে। পাকিস্তানী শাসকদল অগত্যা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখের পর কোন এক সময় মুজিবকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে, যাতে করে তার পক্ষে জেলের অভ্যন্তরে থেকেও চিরকুট বা অন্য যে কোন পন্থায় আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের সম্ভাব্য এ্যাকশনের ব্যাপারে মুজিব ও তাঁর সাথীরা পূর্বাহ্নেই জানতেন। ফলত, মুজিব যথারীতি ফরিদপুর যাওয়ার আগে ও পরে সেখান থেকেই বিস্তারিত নির্দেশনাবলী সংবলিত চিরকুট ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে ধারাবাহিকভাবে পাঠাতে থাকেন যা রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামকে বেগবান করে ও সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলনে মুজিব আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করেন। ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিটিও উত্থাপন করেন সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্য প্রদানকালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস তিনি হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান এবং পুনরায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জোর দাবি জানান। অমর একুশের পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার জনতা তাদের সকল আশার প্রতিভূ যুক্তফ্রন্টকে প্রাদেশিক পরিষদে এনে দেয় নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়, যা মোট আসনের শতকরা ৯৪ ভাগ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলার মানুষকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায়। এই ষড়যন্ত্রের পথ ধরেই আসে অইয়ুব-মোনেম-ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র। সমান্তরালভাবে বেগবান হতে থাকে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের মাধ্যমেই শেখ মুজিব রূপান্তরিত হন বাংলার মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুতে। তাঁর নেতৃত্বে অনেক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে, লাখো মা-বোনের অসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীন বাংলাদেশ। জিন্নাহর ঢাকা সফরকালীন ঘোষণা ১৯৪৭ সালে স্বাভাবিক কারণেই আমাদের আন্দোলনগুলোতে স্বাধীনতা, স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের কোন এজেন্ডা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাতুরি, বিশ্বাসঘাতকতা ও লুণ্ঠনের বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হওয়া সত্ত্বেও বাঙালীরা তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে বসবাস করার জন্য। অপরদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক জোট একত্রে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল ’ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের’ মুখোশের আড়ালে পূর্ব বাংলাকে ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতে। তাদের এই পরিকল্পনার প্রকট বহির্প্রকাশ ঘটে তখনই যখন ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ বা তার অনুসারীরা কখনই এ ধরনের অবিবেচক এবং একতরফা সিদ্ধান্তের কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে সক্ষম হননি বা সে প্রচেষ্টাও তাদের মধ্যে কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে চার কোটি বিশ লাখ বা তারচেয়েও বেশি মানুষের, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অবশিষ্ট তিন কোটি তিরিশ লাখের বসবাস ছিল অন্য সব প্রদেশ মিলিয়ে। পাকিস্তানে তখন পূর্ববাংলা ছাড়াও আরও চারটি প্রদেশ ছিল। তারচেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উর্দু ভাষা পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের মানুষেরই মাতৃভাষা ছিল না। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশেরও কম মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলত এবং তারা মূলত ছিল ভারত বিভাগের আগে ও পরে ভারত থেকে পাকিস্তানে আগমনকারী বাস্তুহারা মানুষ যাদের মুহাজির বলা হতো। পৃথিবীর সব মানুষের মাতৃভাষাই সম্মানের। তার পরও বিবিধ কারণে কিছু ভাষার উৎকর্ষ অন্য ভাষার চেয়ে অধিক হয়ে থাকে। বিষয়টি বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে, রাষ্ট্রভাষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মি. জিন্নাহর বাংলা ভাষাকে যে কোন মাপকাঠিতেই বাতিল করে দেয়ার বিষয়টি ছিল অপরিপক্ব ও অর্বাচীন আচরণ। এ ভাষার ঐতিহাসিক উত্তরণের পটভূমি, এর বিশালত্ব, বিশ্ব স্বীকৃতি, কোনটিই ১৯৪৭ সালে একে পাকিস্তান বা এ উপমহাদেশের বা বিশ্বের অন্য কোন ভাষার সমকক্ষ না ভাবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। সেটি ছিল বাংলা ভাষার রেনেসাঁর যুগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সময়টি ছিল নজরুল, বঙ্কিম, শরৎ, জীবনানন্দ, সুকান্ত, মধুসূদন, বিদ্যাসাগর এবং এদের মতো আরও অনেক বিশাল ব্যক্তিত্বের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পদচারণার সময়। এই প্রেক্ষাপটে এ ভাষাকে অবহেলা করা ছিল নিজের অজ্ঞতা ও দীনতার বহির্প্রকাশ। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ কাজটি করে নিজের দীনতাকেই প্রকারান্তরে প্রকাশ করেছেন ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস হচ্ছে মানুষের অধিকার হরণ, শোষণ, বঞ্চনা, ষড়যন্ত্র ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস। দেশটির আবির্ভাবের প্রথম দশকেই কমপক্ষে সাতজন প্রধানমন্ত্রী, চারজন গবর্নর জেনারেল এবং একজন প্রেসিডেন্টকে বলপূর্বক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছরের তথাকথিত ঐক্যের ১৩ বছর কেটেছে সরাসরি সামরিক শাসনের যাঁতাকলে। গণতন্ত্রহীনতা ও অধিকার হননের এই ২৩ বছরে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছে বাংলার মানুষ। অথচ বাঙালীরাই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আলোকে দেশ গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে দেশ বিভাগপূর্ব গণভোটে (Plebiscite) বাংলা ও সিন্ধু ছাড়া আর সব প্রদেশই অবিভক্ত ভারতকে খন্ড বিখন্ড করে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে। সিন্ধুতেও মুসলিম লীগ জিতেছিল মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হচ্ছে এই যে, পাকিস্তান গঠনে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখা বাংলাই সবচেয়ে আগে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে রাষ্ট্র কাঠামো হতে। নিজের জীবদ্দশায় মি. জিন্নাহর একবারই বাংলায় আসার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের সেই আগমন পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য ও জিন্নাহ সাহেবের নিজের জন্যও ভাল কিছু বয়ে নিয়ে আসে নাই। তার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ২১ মার্চের বক্তব্য বস্তুতপক্ষে সরাসরি প্রকাশ করে দিল বাংলার প্রতি পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ ও এলিট শ্রেণীর অবজ্ঞা ও অসহিষ্ণুতার বিষয়টি। জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্তসমূহ এর পর থেকে বার বারই চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতে থাকে পূর্ব বাংলার ওপর, যা এদেশের মানুষকে, রাজনীতিকে ও সমাজকে রাজনৈতিকভাবে আরও সুসংহত হওয়ার পথে নিয়ে যায়। এ দেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষত রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে থাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলার অমর্যাদার বিষয়টি। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×