ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদায়, কবি!

প্রকাশিত: ০৯:২০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিদায়, কবি!

কবির রচনা হতে পারে চিরজীবী, কিন্তু কবি রক্তমাংসের মানুষ, নশ্বর মানুষ; তাই কবিকেও বিদায় নিতে হয়। চলে গেলেন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ কবি আল মাহমুদ। কিছুদিন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন, বয়স হয়ে গিয়েছিল আশির ওপর। এই বয়সে অসুখ-বিসুখের দংশন যেন স্বাভাবিক। তবে কবি প্রায় এক যুগ আগে থেকেই ভুগছিলেন দৃষ্টিশক্তির পীড়ায়, প্রায় কিছুই দেখতে পেতেন না স্পষ্ট করে। তারপরও শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে কবিতা লিখে গেছেন। এমনকি অবাক হতে হয়, কোন কোন ঈদসংখ্যার জন্য বড় গল্প বা উপন্যাসিকাও লিখেছেন। লেখার প্রতি তাঁর ছিল এমনই অনুরাগ। তাঁর লেখা এখন চিরতরে থেমে গেল। কেননা কবিকে চিরশয্যা পেতে দিয়েছে জন্মভিটে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মোড়াইল গ্রাম। রইল পড়ে কবির সৃষ্টিসম্ভার, অসাধারণ রত্নমালা। শুধু কবিতাই তো কবি লেখেননি, লিখেছেন আশ্চর্য সব হৃদয়স্পর্শী ছড়া, লিখেছেন গল্প-উপন্যাস। কথাসাহিত্যেও তাঁর অবদান অসামান্য। ভাষার জাদুকর ছিলেন তিনি। কোত্থেকে যে তুলে আনতেন চমকলাগানো ছন্দোময় বিদ্যুল্লতা, গ্রামবাংলার অকৃত্রিম নান্দনিক ছবি তাতে কথা বলে উঠত। পাওয়া যেত নদী ও নদীকূলের সৌরভ, নর-নারীর একান্ত সম্পর্কের বিবিধ বিচিত্র ধ্বনি। আঞ্চলিক শব্দও যে আধুনিক কবিতার মূল¯্রােতে এসে আছড়ে পড়তে পারে অবিনাশী ঢেউয়ের মতো- তা চমৎকারভাবে প্রথম বোঝা গেল আল মাহমুদের কবিতায়। মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে তাঁর কবিতার চরণ তুলত অনুরণন। তাঁকে অভিধা দেয়া হয়েছিল ‘সোনালী কাবিনের’ কবি বলে। কবির নিজেরও প্রিয় ছিল ওই সনেটগুচ্ছ। লিখেছিলেন, ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী / যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি। তবে কবির পথ ফুলে ফুলে শোভিত ছিল না। মাত্র আঠেরো বছর বয়সে এসেছিলেন এই পাষাণনগরী ঢাকায়। এলিটদের রাজত্বে এসে পড়া আলাভোলা সরল গ্রামীণ কিশোর যেন। পঞ্চাশের দশকের কবিতাকাশে তখন নক্ষত্রের মতো বিরাজ করছেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমানের মতো গুণী কবি। নিজের আসন নিজেকেই তাঁর অর্জন করে নিতে হয়েছিল। একাডেমিক সনদ না থাকায় অর্থোপার্জনের পথটিও ছিল দুর্গম। পরিবারের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য যতটুকু কর্মনিযুক্তি দরকার, সেটুকু শেষ করে প্রত্যাবর্তন করতেন লেখার টেবিলে। তবে সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন তাঁকে স্বস্তিকর চাকরি। শিল্পকলা একাডেমির চাকুরি কবি করেছিলেনও পুরো আঠেরো বছর। পরবর্তীকালে অবশ্য অনেক সময় উপার্জনহীনও থেকেছেন, কিন্তু লেখনী থামেনি তাঁর। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে কবিতা নামের রহস্যময়ীর মায়াতে বাঁধা পড়া বাঙালীর মুখে মুখে উচ্চারিত হতো কবির বহু পঙক্তি। যেমন, ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে- চুল খোলা, আয়শা আক্তার।’ এমন চরণ হয়ে উঠেছে প্রবাদতুল্য। সেইসঙ্গে ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন’- এমন উচ্চারণে বঞ্চিত শোষিতের পক্ষে থাকা বৃহত্তর মানুষ এক ধরনের অন্তর্শক্তি পেয়েছে। সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নকল্পনার কথা সুন্দরভাবে আছে এতে। মানুষের মনকে শিল্পরসে রাঙানো, তাকে শক্তি জোগানো, সান্ত¦না দান, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ রূপে যাপনের ইশারা আছে তাঁর কবিতায়। প্রকৃত কবি হলেন ভাষার বরপুত্র, প্রকৃতির মোহন বীণা। আল মাহমুদের মতো একজন বড় মাপের কবি বিদায় নিলেন বাংলা ভাষার মাসে। বাংলা কবিতার চিরজীবী সম্পদের ভা-ারে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে তাঁর কবিতা- কবিতাবোদ্ধা যে কারু পক্ষেই এ সত্য অনুধাবন অসম্ভব নয়। তিনিই তো লিখেছেন, পরাজিত হয় না কবিরা।
×