ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

ঠিকানা টুঙ্গিপাড়া

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ঠিকানা টুঙ্গিপাড়া

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি কয়েকটি উপস্থাপনা ও আলাপচারিতায় উল্লেখ করেছেন এই মেয়াদের শেষেই তিনি অবসরে যাবেন ও বাকি জীবন তাঁর গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় অতিবাহিত করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘোষণা এর আগে কখনও আসেনি। বিশেষত রাজনৈতিক কর্মকা-ে ও শীর্ষ পর্যায়ে দেশ পরিচালনা শেষে কেউ গ্রামে ফিরে গিয়ে জীবন কাটাবেন ভেবেছেন বা কাটিয়েছেন এমন উদাহরণও নেই। আজ থেকে ৭২ বছর আগে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ হাসিনার জন্ম। ৭২ বছর আগে সে গ্রাম কেমন ছিল আমরা এখন কিছুটা অনুমান করতে পারি। দৃশ্যকল্পের টুঙ্গিপাড়া ও তার সংলগ্ন গ্রামগুলোর বাস্তব বিবরণ পাই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও তাঁর বই ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে তাঁর গ্রাম নিয়ে লিখেছেন, ‘বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকে বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতি নদীতে। এই মধুমতি নদীর অসংখ্য শাখা নদীর একটি বাইগার নদী। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে।’ বাংলাদেশের শহরের সব মানুষেরই একটি গ্রাম আছে আর সেই গ্রামের ছবি এরকমই যা লিখেছেন শেখ হাসিনা। যে কেউ এই বাক্যগুলো পড়লে তার নিজের গ্রামের স্মৃতিতে ফিরে যাবেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে তাল-তমাল-হিজল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীর স্রোতে মাঝির ভাটিয়ালি সুর এটাই আসল বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের প্রাণ হলো তার গ্রাম যা হারিয়ে আমরা কুড়ি-পঁচিশ ভাগ মানুষ শহরবাসী হয়েছি। ফেলে আসা গ্রাম, গ্রামের মানুষ যতই অপেক্ষায় থাকুক আমাদের নতুন করে গড়ে তোলা বনেদী শহুরে সংস্কৃতি দিয়ে সাজিয়েছি নষ্ট পুতুলের খেলাঘর। গ্রামের সুরূপা সৌন্দর্য কর্দমামলিন করে এক মিশেল বাণিজ্যের বাজার তৈরি করেছি ও তা গ্রামগুলোয় চাপিয়ে দিয়েছি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে বটে কিন্তু তা বাজার নির্ভর। স্কুল-কলেজ বা শিক্ষা-দীক্ষায় নিবেদিত প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক কদর্য মেখে হয়েছে জ্ঞানবিমুখ ও অনুৎপাদক শ্রেণী সৃষ্টির কারখানা। এতে শহরের লাভ বেশি, কম পয়সা দিয়ে শ্রমিক পুষবার সুযোগ তখন বেশি। মাদক আর অনাসৃষ্টি ছড়িয়ে সস্তা ফিল্মী বাণিজ্যের ব্যবসা শুরু হয় আশির দশকে। ঘরে ঘরে টিভির বাজার হলো কিন্তু কন্টেন্ট সব শহরের চকমকা বিজ্ঞাপনী সংস্কৃতির। নাটকগুলো দেখাতে শুরু করল শহুরে স্বপ্ন, সাজতে হবে তেমন করেই যেমন করছে নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলো। বদলে গেল পরিবারের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি আর মূল্যবোধ। মোটরসাইকেল এসে জায়গা করে নিল বাই-সাইকেলের, রাস্তাগুলোর দখল নিল ইঞ্জিন আর পেট্রোল, দু’পাশের সবুজ গাছগুলো সব বিবর্ণ হতে থাকল। গ্রাম হারাল তার সবুজ। কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের গ্রাম হয়ে ওঠে নাগরিক সমাজের চিন্তা ও চেতনার বাহক। কারণ পাকিস্তান জন্মের পরে যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র সামনে এসে হাজির হয় তা মধ্যবিত্তের রাজনীতির বিষয় হলেও গ্রাম-সমাজের বৈকল্য নিরসনের জন্য কোন উদ্যোগ ছিল না। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর রচনাতেই দেখা মিলে কেমন করে গ্রামের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান চল্লিশের দশকে কলকাতার উঠতি ও কুলীন মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক নেতাদের চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় বিবৃত আছে গ্রামের ছেলের সমাজকর্মী হিসেবে উত্থান কতটা নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে ছিল (হাতে টাকা-পয়সা সব কর্মীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া, সম্মেলন শেষে দিল্লি থেকে ট্রেনে সারা পথ প্রায় না খেয়ে কলকাতায় ফিরে আসা, দাঙ্গার সময়ে নিজে ঠেলাগাড়ী টেনে হোস্টেলে হোস্টেলে খাবার পৌঁছে দেয়া) যা এখনকার বাস্তবতায় কোন ছাত্রনেতার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এমন নির্মোহ রাজনীতির চর্চা তিনি করেছিলেন গ্রামের ছেলে বলেই। ফলে তিনি যে চোখে গ্রামের মানুষের জন্য ভেবেছেন ও সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তার একটি সুদূরপ্রসারী স্বপ্নের বাক্য নিয়ে, ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ও সোনার বাংলা ফিরিয়ে আনতে’ সেটাই হয়ে উঠল বাংলাদেশের রাজনীতির আরাধ্য চেতনা। তাহলে গ্রাম বাংলা দুঃখী হলো কেন? কোথায় গেল সেই সোনার বাংলা? যারা বঙ্গবন্ধুর ’৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লণ্ডনের প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য শুনেছেন (ইউটিউবে পাওয়া যায়) তারা দেখেছেন সেদিন এক বিলেতি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তরে কী দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন- “you know Bengal is an wonderful country, it has very good resources, very good fertile lands, but unfortunately exploited for hundreds of years by the foreign powers, and I think you gentlemen who are British– citizen of Great Britain– you have responsibility for Bangladesh also– because we have contributed many things of our resources from the Bengal soil...” এই যে বাংলাদেশের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক তরুণ যিনি কি-না ৫১ বছর বয়সে একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছেন, হয়েছেন জাতির পিতায় অভিষিক্ত। তিনিই ব্রিটিশদের কাছে তাদের ঘরে বসে বলে বসলেন এমন কথা যে, তাদেরও দায়িত্ব আছে ফিরিয়ে দেবার। এটা বাংলাদেশের গ্রামের তরুণের পক্ষেই সম্ভব। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন সে অনিবার্য দাবি সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষেরই দাবি ছিল। এমন বিদ্রোহী দাবি ভারতবর্ষের কোন নেতৃত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুখে কখনও ছুড়ে দিতে পারেনি। এ কথাও সত্য যে, বাঙালী মুসলমানের জাত্যাভিমান ও ব্রিটিশ কুচক্রের তৈরি ধর্ম-কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বিরোধ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি করেছিল সেটাও এদেশে পরাশক্তির প্রভুত্ব বিস্তারের ও নিজেদের রাজনৈতিক দূরত্বের বড় কারণ হয়েছিল। ফলে আমরা দেখতে পেয়েছি নানা রকম সংঘাত, অবিশ্বাস ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের রাজনীতি শাসনতন্ত্রেও বিস্তার লাভ করেছিল যার কারণে গ্রামবাংলার উন্নয়ন বা মানুষের কথা ভাবার অবকাশ রাজসভায় প্রায় হয়েই উঠেনি। শোষণ হয়েছে শাসনের প্রতিভূ, মানুষের স্বপ্ন দেখাবার কোন নীতি গড়ে ওঠেনি। ফলে গ্রাম গ্রামই থেকে গেল, আর শহর উঁচু হতে থাকল। কিন্তু সেখানে যদি মানুষের কোন স্বপ্ন না থাকে তাহলে সেসব হাইরাইজের সংস্কৃতি ধারণ করবে কে? আজ আমরা যে গ্রাম-শহরের বৈষম্য দেখি তা হঠাৎ করে হয়নি। পাকিস্তানী আমলে আমাদের মনোজগতে শিক্ষা ও অশিক্ষা একইসঙ্গে বিকশিত হয়েছে যার ফলে আমাদের শহুরেদের নৈতিক দায় ও সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষার অপমৃত্যু হয়েছে। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দেখা গেল শহরের তুলনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অবিকৃত গ্রাম সমাজের স্বল্পশিক্ষিত ভুখা নাঙ্গা কৃষক পরিবারের তরুণের সংখ্যাই ছিল বেশি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে গ্রাম সমাজ কোন অংশে কম আন্দোলিত হয়নি কারণ তিনিই প্রথম তাদের (আমার বাংলার, আমার সোনার বাংলার, আমার বাঙালীর) আশা আকাক্সক্ষার দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রাজনীতির দৃশ্যপটে। যদি উল্টো করে দেখা হয়, শহরের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামেই আশ্রয় নিয়েছিল যে গ্রামে কদাচিৎ সে যেত। যে গ্রাম ছিল ডার্টি হরিজনের সে গ্রাম তাঁর জন্য ছিল নিশ্চিত নিরাপদ। আমাদের নিশ্চয়ই ভুলে গেলে চলবে না কেমন করে গ্রামের মানুষ তখন চেনে না জানে না এমন সব পরিবারগুলোকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঠাঁই দিয়েছিল তাদের শোবার ঘরে। সেই গ্রাম যেন আর পেছনে পড়ে না থাকে বঙ্গবন্ধু সে স্বপ্ন দেখেছিলেন আর তাঁর সকল আয়োজন স্বাধীন বাংলাদেশে করেও ছিলেন। কিন্তু শহরের ‘চাটার দল’ তাঁর মতো মহানুভবের মর্যাদা বুঝে নাই। গ্রামের কোন লোক এসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, শহরের জাতপাতের কুলীনেরাই সুযোগ বুঝে এই ঘৃণ্য কাজটি করতে পেরেছিল। এদেশের শহরের প্রতিটি মানুষের যেমন একটি গ্রাম আছে, সে গ্রামের প্রতি তাঁর দায় আছে দায়িত্বও আছে কারণ শহরের সব মানুষের ঋণ আছে গ্রামের প্রতি। সে ঋণ অপরিশোধ্য। যখন বাংলাদেশের সব গ্রাম একজন বুকে ধারণ করেন তিনিই বঙ্গবন্ধু হতে পারেন, আর যিনি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করতে পারেন তিনি শেখ হাসিনা। এই দু’জন কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সব গ্রামের সব মানুষের আশা আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক ও বিলীন হয়েছেন একই স্বপ্নে। তাদের ঠিকানা তো টুঙ্গিপাড়ায়ই হবে। ১৫ আগাস্টের ভয়াল ঘটনাবলীর পরে কুচক্রীরা যখন বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় পাঠিয়ে দিল তখন তাদের ধারণা ছিল সেটাই উত্তম কারণ তাদের সঙ্কীর্ণ শহুরে চিন্তা ছিল উদ্বেগের, তাই দাফনের তাড়াহুড়ো করছিল। কিন্তু তারা বুঝতে অক্ষম ছিল যার হৃদপিণ্ডের নাম বাংলাদেশ তাঁর ঠাঁই তো অবশ্যই সেই হিজল-তমালের গ্রামেই হবে। মধুমতির মাঝির ভাটিয়ালি গানের সুরে তাঁর অমল স্পর্শ ঘুরে ঘুরে ফিরে আসবে বাঙালীর ঘরে ঘরে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নের যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় ফিরবেন পিতার স্পর্শের মায়ায় এটাই স্বাভাবিক ও বাঙালীর কাছে চিরসত্য। পিতা-কন্যার যে এক শ’ বছরের জীবন-সংগ্রাম তার শুরু টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকেই, এদেশের মানুষ এই সত্য চিরকাল মনে রাখবে যে সত্য তাঁর সংস্কৃতিতে সে গেঁথেই নিয়েছে। আটষট্টি বছর আগে মধুমতির ঘাটেবাঁধা নৌকায় চড়ে দু’বেণী বাধা যে পাঁচ বছরের শিশুকন্যা হাসিনা ঢাকায় এসেছিলেন তিনি কি জানতেন তাঁর ফেরা হবে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পরে? তিনি কি জানতেন শহরের দুর্ভাগ্য তাঁকে প্রতিদিন মৃত্যুর ফেরারি করে জীবনের কাছে বন্দী করে রাখবে? কিন্তু অপ্রতিরোধ্য বাঙালীর স্বপ্ন আকাক্সক্ষাকে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি যদি তাঁর জন্মগ্রামে ফিরে যান আমরা তাঁকে আমাদের সকল ভালবাসার সম্মান জানাই। কারণ, শেখ হাসিনার চোখে ‘টুঙ্গিপাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের নাম’। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×