ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

(গতকালের পর) ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চের রেসকোর্সের বক্তব্যে জিন্নাহ ঘোষণা করলেন : ‘আমি আপনাদের সবাইকে অত্যন্ত পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। এ ব্যপারে যে বা যারাই আপনাদের বিভ্রান্ত করবে, সে অবশ্যই পাকিস্তানের শত্রু। ’(Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Aûone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan’)। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাঁর এই বক্তব্য কেবলমাত্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতিকে অবহেলাই করেনি, বরং এটা প্রকাশ করে দিল তাঁর অগ্গতা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব। জিন্নাহ সাহেবের অযৌক্তিক জেদ ও জবরদস্তিমূলক বক্তব্য পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পাঞ্জাব ও সিন্ধুর এলিট শ্রেণীর মনোভাবের বহির্প্রকাশ ছিল, যারা পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের মানুষের অধিকার নিয়ে সবসময়ই ছিনিমিনি খেলেছে। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ মোহাম্ম্দ আলী জিন্নাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত কনভোকেশনে রাষ্ট্রভাষা ইস্যুতে আরও আক্রমণাত্মক ভাষায় তাঁর ইতোপূর্বে প্রদত্ত বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন। মি: জিন্নাহ বাংলা ভাষার সন্মান রক্ষায় আন্দোলনরত ছাত্র, শিক্ষকসহ এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানের শত্রু ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অপমানিত করেন। জিন্নাহ ভাষা ইস্যুটিকে ভারতের দালালি বলে অখ্যায়িত করেন। তাঁর ভাষায় : ‘Our enemies, among whom I regret to say, there are still some Muslims, have set about actively encouraging provincialism in the hope of weakening Pakistan and thereby facilitating the re-absorption of this province into the Indian Dominion’. এর ভাষান্তর করলে যা দাঁড়ায় তা হলো : ‘আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এখনও কিছু মুসলমান (নামধারী) শত্রু আমাদের মাঝে আছে যারা প্রাদেশিকতাকে উস্কে দিচ্ছে এবং পাকিস্তানকে দুর্বল করে পুনরায় ভারতের অংশীভূত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ বাঙালীর নিজের ভাষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবিকে জিন্নাহ পাকিস্তানের ঐক্য বিরোধী হিন্দুস্তানী দালাল চক্রের কাজ বলে অভিহিত করলেন! এভাবেই পরবর্তী সময়ে সব সময়ই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকের দল এবং তাদের এদেশীয় বশংবদেরা বাংলার অধিকারের সকল প্রশ্নেই ভিনদেশী বা কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করতে থাকল। জিন্নাহর ঢাকা সফর তাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে কেবল একটি ব্যর্থ মিশন হিসেবেই নয় বরং এই সফর পূর্ব বাংলার মানুষকে প্রকৃতপক্ষেই অসন্তুষ্টি এবং অবিশ্বাসের এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে ফিরে আসা দুরূহ ছিল। তারপরও বাংলার মানুষ আরও অনেক বছর পাকিস্তানের কাঠামোর অভ্যন্তরে বসবাস করেছে অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের শাসককুলের বোধোদয় কখনও হয়নি। সম্ভবত সেটা হওয়া সম্ভবও ছিল না। আজও পাকিস্তানে জাতিগত বিভেদ এবং হানাহানি পৃথিবীর অনেক দেশ ও জাতির চেয়ে বেশি। তার চেয়েও বেশি খারাপ হচ্ছে তাদের ধর্মের আবরণে নৃসংশতা চালিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। জিন্নাহর আক্রমণাত্মক ও আপোসহীনতা এ দেশের জনগণের কাছে তার ও প্রকারান্তরে প্রতিটি পাকিস্তানী শাসকের ভাবমূর্তিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে যায়। বাংলার রাজনীতিবিদগণ তখন থেকেই সুচিন্তিতভাবে পাকিস্তানীদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করতে থাকেন। জনগণের মাঝে যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যের মিথ তৈরি করা হয়েছিল তার স্বরূপ উদঘাটিত হয়। আসলে এই সফরটিকে ধরা যায় পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের এবং পাকিস্তানী শাসকদের সম্পর্কের এসিড টেস্ট হিসেবে। বাংলার মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা যতই ভ্রাতৃত্বের কথা বলুক না কেন, তারা কখনোই তাদের স্বার্থের পরিপন্থি কিছুই বাংলার মানুষের জন্য কখনও করবে না। বরং নিজস্বার্থ হাসিল করার জন্য প্রয়োজনে এ দেশের মানুষকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করবে। এদেশের নিরাপত্তা বিধানের কোন পরিকল্পনাও তাদের কখনোই ছিল না। এ বিষয়টি আরও ভালভাবে বোঝা গেল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থাই ছিল না। অথচ পাকিস্তানের রফতানি আয়ের শতকরা ষাট ভাগেরও অধিক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অবদান। আর এ অর্থ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের এক-পঞ্চমাংশেরও কম। ফলত, ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধে বাঙালীরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হলো যে, পাকিস্তানের কাঠামোয় জাতি হিসেবে তাদের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণরূপে অনিরাপদ। জিন্নাহ-প্রদর্শিত পথ ধরে এরপর থেকে সকল পাকিস্তানী শাসকরাই এদেশের জনগণের সকল প্রকার অধিকার আদায়ের অন্দোলনকে সর্বদাই ভারতের ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করে দমন-পীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে। একের পর এক ক্ষমতা দখলকারী পাকিস্তানের সামরিক শাসকের দল বাংলার জনগণের প্রাণের দাবিগুলোর সঙ্গে তথাকথিত ভারতের ষড়যন্ত্রের মন্ত্রকে একীভূত করে নিরীহ মানুষের ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে উস্কে দিয়ে তাদের কায়েমী স্বার্থকে রক্ষা করতে লাগল। মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ সামরিক ও আধাসামরিক শাসকের দল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য ধারাবাহিকভাবে জনগণের মাঝে ভারতবিরোধিতার বীজ বপন করে যেতে থাকল। প্রয়োজনানুযায়ী ছোট বড় সীমান্ত সংঘাত বা যুদ্ধ বাধিয়ে দুই দেশের শাসকরাই নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার প্রচেষ্টা ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর থেকেই চালিয়ে যেতে থাকল। পাকিস্তানের অবৈধ ক্ষমতা দখলদারীদের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে চতুর এবং ফলপ্রসূ কৌশল। যখনই মানুষ গণতন্ত্র, সুশাসন বা মানবাধিকারের প্রশ্নে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হতো তখনই তারা তাদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য ভারতীয় জুজুকে টেনে নিয়ে আসত। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সর্বোপরি শত ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সারা বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের জন্য এই বার্তাই বহন করে যে অত্যাচারী, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী শোষকের দল যত শক্তিশালীই হোক না কেন শেষাবধি জনতার শক্তির কাছে তাদেরকে মাথা নত করতে হয়। রেসকোর্সের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত অতি আলোচিত ও সমালোচিত বক্তব্য দেয়ার ছয় মাস পর ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হয়। কিন্তু যে রাজনৈতিক দর্শনের তিনি গোড়াপত্তন করেন এবং সযত্নে লালন করে যান তাঁর সকল উত্তরসূরী সেই দর্শনকে আঁকড়ে ধরে পাকিস্তানের ঝান্ডা উড়িয়ে চলতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানী সকল নেতা, পূর্ববাংলার অবাঙালী ও বাঙালী কট্টর মুসলিম লীগারের দল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শেষাবধি বাঙালীদের সকল বৈধ দাবির মধ্যে সর্বদাই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেতে লাগল। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×