ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দের ধানসিড়ি এখন মরা খাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

জীবনানন্দের ধানসিড়ি এখন মরা খাল

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো-বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের অমর সৃষ্টি ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় উঠে আসা নদী ধানসিড়ি। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি থেকে রাজাপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার বয়ে চলা নদীটির দুই পারের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবি তার কবিতার মধ্যদিয়ে আবারও শঙ্খচিল বা শালিখের বেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ধানসিড়ি নদীতীরে। অথচ কবির আরাধ্য সেই ধানসিড়ি আজ মরা খাল। দিনে দিনে নাব্যতা হারিয়ে শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হয়ে এটি ধুঁকছে অস্তিত্ব সংকটে। সময়মতো খনন না হওয়া, অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া, পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ধানসিড়ির দৈর্ঘ্য এখন চার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এই অংশটুকুতে কোনোক্রমে পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে একসময়ের খর¯্রােতা ধানসিড়ি। বর্ষায় কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হলেও শীত মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে প্রাণহীন হয়ে পরে রূপসী বাংলার এই নদী। দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী আজও কবির প্রিয় ধানসিড়ি নদী দেখতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সূত্রমতে, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে গাবখান চ্যানেল ও বিষখালী নদী শুরু হয়েছে। এই তিন মোহনা থেকে উত্তর-পশ্চিমে বয়ে চলা জলধারার নাম ধানসিড়ি। ঝালকাঠির মোল্লাবাড়ি ও ছত্রকান্দা গ্রামের ভেতর থেকে চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ও রাজাপুরের বাড়ইবাড়ি, পিংড়ি, হাইলাকাঠি, ইন্দ্রপাশা ও বাঘড়ী গ্রামের মধ্যদিয়ে বাকি আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রাজাপুর সদর খালের মোহনায় মিশেছে ধানসিড়ি। সেখান থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে জাঙ্গালিয়া নদী হয়ে আবার বিষখালী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে ধানসিড়ির প্রবাহ। সূত্রে আরও জানা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খাল কাটা কর্মসূচির আওতায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নদীটির কিছু অংশ খনন করা হয়েছিল। এরপর আর তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সড়কপথ তৈরির আগে ঝালকাঠি জেলা সদরের সাথে রাজাপুর উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ধানসিড়ি নদী। অতীতে এই নদী দিয়ে এক্সপ্রেস সার্ভিসের স্টিমার খুলনা-কলকাতায় যাতায়াত করতো। বড় বড় মালবাহী পাল তোলা নৌকা এবং সাম্পানও চলাচল করতো ধানসিড়ি নদীতে। দুই যুগ আগেও ধানসিড়ি নদীতে লঞ্চ ও কার্গো চলাচল করতো। বর্তমানে রাজাপুর উপজেলার পাড়েরহাট এলাকা থেকে ভরাট হয়ে ধানি জমির সাথে মিশে গেছে ধানসিড়ি নদীর বাকি অংশ। তলদেশে পলি জমে ভরাট ও দখলদারির ছোবলে ধীরে ধীরে ধানসিড়ি শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। এই খালে এখন নৌকা চলাচলও করতে পারেনা। যেখানে পানি থাকে সেখানেও কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে খননকাজের জন্য তিন বছর আগে ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই প্রকল্পে ধানসিড়ির পার পরিস্কার করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। ধানসিড়ি পারের বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল গাজী বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় এই নদীতে আমরা স্টিমার চলতে দেখেছি। এখন আর নৌকাও চলাচল করতে পারেনা। তার পরেও যতটুকু আছে তা টিকিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে খননের কোন বিকল্প নেই।’ স্থানীয় কৃষক কাশেম হাওলাদার বলেন, ‘ধানসিড়ি নদীর পানি দিয়েই হাজার হাজার কৃষক মাঠে ফসল ফলিয়েছে। এখন শীতকালে নদীতে পানি না থাকায় আমরা চাষাবাদ করতে পারছিনা।’ রাজাপুর নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সৈয়দ হোসাইন আহমেদ কামাল বলেন, ধানসিড়ি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই নদীকে বাঁচাতে আমরা একাধিকবার মানববন্ধন ও প্রশাসন বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা মনে করি নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে কিন্তু কিছু অর্থলোভীর কারণে ধানসিড়ি আজ মৃত্যুর মুখোমুখি। জীবনানন্দ দাশ ও ধানসিড়ি নদী সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদ কর্মীরা বলেন, ধানসিড়ি নদী নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোয় অসংখ্যবার সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। কখনও ইতিহাস নিয়ে, কখনও বর্তমান অবস্থা নিয়ে। নদীর আগের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে জরুরী ভিত্তিতে খনন প্রয়োজন। রাজাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উল্লাহ্ বাহাদুর বলেন, ধানসিড়ির দুই পারে শত শত হেক্টর উর্বর ফসলি জমি থাকলেও নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারছেন না। নদীটিতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে পারলে ধান ও রবি শস্যের ব্যাপক আবাদ সম্ভব হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফরোজা বেগম পারুল বলেন, ধানসিড়ি খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবরে গত বছরই সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই বরাদ্দ হওয়ার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বরাদ্দ পেলেই ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ধানসিড়ি নদীর খননকাজ শুরু করা হবে।
×