ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাদারীপুরে মায়ের কোলে চড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে প্রতিবন্ধী লাবনী

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মাদারীপুরে মায়ের কোলে চড়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে প্রতিবন্ধী লাবনী

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর ॥ দু’টি পাসহ শরীরের অনেকটা অংশ একেবারেই অচল। হাতও স্বাভাবিক নয়। নিজ পায়ে উঠে দাঁড়াতেও পারেনি দীর্ঘ ১৩ বছর। আর কোনদিন দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও নেই। দিনমজুর বাবার সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ক্লাসেও তেমন একটা অংশ নিতে পারেনি। বাড়িতে পড়েছে নিজে নিজেই। পরিবারের সহযোগিতায় চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় মায়ের কোলে চড়ে এবং যানবাহনে ৪-৫ কিলোমিটার দূরের পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে অংশ নিচ্ছে অদম্য মেধাবী লাবনী আক্তার। লাবনী শিবচর উপজেলার উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। জেএসসিতেও সে ভাল ফলাফল করে। সুযোগ পেলে শিক্ষাকে পুঁজি করে দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে চায়। তবে এসএসসির পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার শংকায় শংকিত পরিবারটি। একাধিক সুত্রে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী লাবনী আক্তার শিবচর উপজেলার উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীু। একই ইউনিয়নের জোগদারমাঠ গ্রামের দিনমজুর হাই ফকির ও মারিয়া বেগমের ৩ সন্তানের বড় সন্তান লাবনী ২০০১ সালে জন্ম গ্রহনের পর ৪ বছর বয়সে কালাজ¦রে আক্রান্ত হয়ে পা দুটি বেঁকে যায়। শরীরের অনেকাংশই অচল প্রায়। হাতে কর্মক্ষমতাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু মা মেয়েকে ঘরের কোনে ফেলে না রেখে বেছে নেন জীবন সংগ্রামের পথ। লাবনী খুব একটা স্কুলে না যেতে পারলেও পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জেএসসিতেও ভাল ফলাফল করে। একদিকে শারীরিক অক্ষমতা তার সাথে দিনমজুর বাবার অস্বচ্ছলতা এরই মাঝে বাড়িতে বসেই লেখাপড়া চালিয়ে যেত। ভালো ফলাফলের আশা শিক্ষকদের। পরীক্ষা ও বিশেষ বিশেষ ক্লাসে মায়ের কোলই ছিলো তার একমাত্র ভরসা। এবারো চলতি এসএসসি পরীক্ষাতেও লাবনী মায়ের কোলে চড়েই প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাচ্ছে। কেন্দ্রের সিটে বসিয়ে দিয়ে মা অপেক্ষা করেন কেন্দ্রের বাইরে। এভাবেই আবার ফেরার পথে মায়ের কোল ও গাড়িতে চড়ে ফিরতে হয়। তার বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও মায়ের অদম্য ইচ্ছা ও পরিবারের সহযোগিতা সম্পৃক্ত। সাথে স্কুলের বৃত্তি ও সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা তার জীবন চলায় সহায়ক হয়েছে। স্কুল শিক্ষক পাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয়দের সহায়তায় এগিয়ে চললেও ভবিষ্যত লেখাপড়া নিয়ে রয়েছে চরম হতাশা। এছাড়া মায়ের বয়স বেড়ে যাওয়ায় লাবনীকে বহনও এখন দুঃসাধ্য। ভাল চাকুরী করে লাবনী পাশে থাকতে চায় নিজের অসহায় পরিবারের। লাবনীর মা মারিয়া বেগম বলেন, ‘৪ বছর বয়সে জ¦র হওয়ার পর থেকে লাবনী হাঁটতে পারে না। হাতও নড়াতে সমস্যা হয়। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি ওর অনেক আগ্রহ; তাই আমি ওকে কোলে করে স্কুলে দিয়ে আসি ও পরীক্ষা শেষে বাড়ি নিয়ে আসি। ওকে যখন কোলে নিয়ে স্বুলে যাই তখন ওর কষ্টের কথা ভেবে আমার বুক ফেটে যায়। স্কুলের সকল শিক্ষক আমার ভাইয়েরা আত্মীয় স্বজনরা ওকে সহযোগিতা করে। লেখাপড়া শিখে লাবনী যদি ভবিৎষতে একটি চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে ওর ভবিৎষত নিশ্চিত হয়। তবে সামনে কিভাবে পড়বে সেই সামর্থ্য বা আমার শারীরিক শক্তি আমার নেই।’ লাবনীর দিনমজুর বাবা হাই ফকির বলেন, ‘আমি অনেক গরিব দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে লাবনীর লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছি। এখন মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। সামনে ওর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি সকলের সহযোগিতা চাই।’ উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রোকনুজ্জামান বলেন, ‘লাবনী আক্তারের দুই পা অচল। আমার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে লেখাপড়া করছে। পরীক্ষার সময় ওর মা ওকে কোলে করে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে যায়, আবার পরীক্ষা শেষে বাড়ি নিয়ে যায়। বরাবরই পরীক্ষায় লাবনী ভাল ফলাফল করছে। বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আশা করি এবারও ভাল ফলাফল করবে। একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় এতদূর এগিয়েছে এটা একটি বিরল ঘটনা।’
×