ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাখাইনে নিরাপদ আবাসন

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 রাখাইনে নিরাপদ আবাসন

বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলার মানুষ অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন। নিজেরা দুঃখ-কষ্টে থাকলেও অন্যের দুঃখ-কষ্টে তাদের মন কাঁদে। এক এক করে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বদেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সত্তায় একজন মমতাময়ী জননী মিশে আছেন বলেই একজন অসহায় রোহিঙ্গার অপমৃত্যু কিংবা অনিশ্চিত বিপদসঙ্কুল জীবন তিনি মেনে নিতে পারেননি। সীমান্ত এক প্রকার খুলেই রাখা হয়েছিল ২০১৭ সালে, যাতে তাড়া খাওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পেতে পারে। আমাদের সরকার প্রধানের এই মানবিক গুণ সম্পর্কে গোটা বিশ্ববাসী জানে। মাদার অব হিউম্যানিটি অভিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এরপর? বাংলাদেশ সীমিত সম্পদের দেশ। তারও রয়েছে অসংখ্য সমস্যা ও সঙ্কট। ভূখন্ডের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। তাই স্থায়ীভাবে এই নতুন ১১ লাখ (যা প্রতিদিনই বাড়ছে সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে) রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থায়ীভাবে ভরণপোষণ এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা কঠিন। অবশ্য সরকার এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য ভাসানচরে আবাসনের পরিকল্পনা করে রেখেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টসহ ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চার দফায় রোহিঙ্গারা বড় পরিসরে বাংলাদেশে এসেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থান করছে প্রায় ১১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৬০ শিশু- এমন সংবাদ আগেই দিয়েছে ইউনিসেফ। এর আগে বিবিসি একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল এক বছরে বাংলাদেশে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেবে। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং তাদের বাংলাদেশে শরণ নেয়ার পর সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাইরের পৃথিবী সম্পূর্ণ অবগত। দু’একটি দেশ ছাড়া সকলেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাসের সকল সুবিধা ও অধিকার প্রদানের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বলেছে। জাতিসংঘ কফি আনান কমিশনের মাধ্যমে সরেজমিনে পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি বাস্তব ও ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব রেখেছে। বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য গত বছর অন্তত ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রয়োজন জানিয়ে গত মার্চে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল জাতিসংঘ। কিন্তু এর মধ্যে ২০ শতাংশও এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বর্তমানে সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ‘সেফ জোন’ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, সরকার এই প্রস্তাবটি আবার নতুনভাবে দিচ্ছে। রাখাইনে একটি সেফ জোন হলে ভারত, চীন ও আসিয়ানের দেশগুলো রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করতে পারে। কারণ, এদের প্রতি মিয়ানমারের আস্থা আছে। রাখাইন- এক বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যা ঘটেছিল তা গণহত্যা বৈ অন্য কিছু নয়। এই নৃশংসতা-বর্বরতা হিটলারের নাৎসী-গেস্টাপো বাহিনী, মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট বাহিনী আর একাত্তরে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন থেকে বাঁচতে যখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই প্রাণভয়ে ছুটছে, তখন যুবকদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে, কুপিয়ে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এত কিছুর পর তাদের সামনে দেশত্যাগ করা ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না। তারা নাফ নদ পেরিয়ে, পাহাড় বেয়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে। আগতদের অনেকে অমানবিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের স্বাক্ষর বহন করছে। এর আগেও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হয়েছিল। তখন ক্ষমতা ছিল সামরিক জান্তার হাতে। সে দেশে ক্ষমতার হাত বদলেছে। কিন্তু নিপীড়নের অবসান হয়নি। এখন বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী ওই রাখাইনেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকারীদের জন্য নিরাপদ ভূমি তৈরি হলে উদ্ভূত সঙ্কটের সুন্দর একটি সমাধান হতে পারে।
×