ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

(গতকালের পর) যখনই বাঙালীরা অধিকার, গণতন্ত্র, সমানাধিকারের দাবি সামনে নিয়ে আসতো তখনই তারা ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাংলার জনগণের দাবিগুলোকে পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে সেগুলোকে দাবিয়ে রাখত। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হতে থাকল এ ধরনের ধোঁকাবাজির রাজনীতির মাধ্যমে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের মার্চে প্রদত্ত বক্তব্য যেখানে তিনি সকল দেশপ্রেমিক বাঙালীকে প্রকারান্তরে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন, সেই বক্তব্য বস্তুতপক্ষে বাংলার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিক বিভেদের সূচনা করে, যা আর কখনও শোধরানো সম্ভব হয়নি। বাঙালী সমাজ : রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ, ছাত্রসমাজসহ সকলেই যারা বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে ছিলেন আপোসহীন, তারা মি: জিন্নাহর বক্তব্যকে ধারাবাহিকভাবে নিন্দা করতে থাকেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, যিনি ছিলেন পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক তিনি সরাসরি জিন্নাহর বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে বললেন যে এ ধরনের অমার্জিত বক্তব্য প্রদান করা ছিল ভুল। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনকে ছাত্রদের মাঝে সুসংগঠিত করার জন্য কাজ করতে থাকেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগের করালগ্রাস থেকে বের হয়ে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের জন্য শেখ মুজিব মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীসহ অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কর্মকা- চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় মুসলিম অওয়ামী লীগ, যা ১৯৫৫ সালে তরুণ শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ও বাস্তবমুখীন পদক্ষেপে আওয়ামী লীগ হিসেবে বাংলার মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলন ॥ বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ এবং রাজনীতিবিদগণ কখনই বাংলাকে একটি উপনিবেশের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়নি। দেয়ার কোন সদিচ্ছাও কোনকালে তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। জিন্নাহর পূর্ব বাংলা সফরের পর পাকিস্তানীরা যে কোন পন্থায় এ দেশের মানুষকে শিক্ষা দেয়ার মানসে তাদের অভিযাত্রা শুরু করে। অপরদিকে, পাকিস্তান সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা বাঙালীদের মননে তখন থেকেই স্বাধিকারের বিষয়টি গেঁথে যায়। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সর্বস্তরে বিকশিত হতে থাকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা। বাংলার মানুষের কাছে তখন থেকেই এটি পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে যে বাঙালীরা একটি আলাদা জাতি। একমাত্র ধর্ম ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে এদেশের মানুষের কৃষ্টি, সভ্যতা, ভাষা, কোনকিছুরই কোন মিল নেই। জিন্নাহর ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর সভা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় উভয় পক্ষের অনমনীয় মনোভাবের কারণে। জিন্নাহ একমাত্র উর্দু ছাড়া আর কোন ভাষা, তা যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিতে পুরোপুরি অস্বীকার করে। অপরদিকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর সদস্যরাও বাংলার মানুষের দাবির প্রতি অটল থাকেন। পাকিস্তানের ধ্বংসের কারণ খুঁজতে গিয়ে আজ অনেকেই, বিশেষত: পাকিস্তানীরা ও বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থীরা অনেক ধরনের তত্ত্বের অবতারণা করে থাকেন, যা সত্যের অপলাপ এবং মূল কারণকে এড়িয়ে অন্য কারণ খুঁজে বের করার প্রয়াস। পাকিস্তানের জন্মের মধ্যেই এই রাষ্ট্রের মৃত্যুর ফরমান লেখা ছিল। ধর্মীয় ভ্রাতৃবোধের যে কাহিনী মুসলিম লীগ রচনা করেছিল ১৯৪৭ সালেরও বহু পূর্বে সে ভ্রাতৃত্ববোধ একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। যে কারণে যখনই রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয় এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের বিষয়গুলো নিষ্পত্তির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেও এই কথাটি উচ্চারিত হয়েছে। মৌলিক স্বার্থের ব্যাপারে পাকিস্তানীরা এদেশের মানুষের সঙ্গে কোন প্রকার সমঝোতায় কখনোই আসেনি। তাই ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে বাঙালীর যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও বাংলার মানুষকে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই একই ব্যাপার ঘটেছিল ১৯৭০ এর নির্বাচনের পরও। কিন্তু ততদিনে বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান হয়েছে, যে উত্থানকে আগের মতো কিংবা তার চেয়েও আরও অনেকগুণ বেশি শক্তি প্রয়োগ করেও দমানো সম্ভব হয়নি। জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের ঢাকা সফর পাকিস্তান রাষ্ট্রের নীতিগত বৈষম্যগুলোকে উস্কে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে এর দুর্বলতাগুলো ও পাকিস্তানের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি (পলিসি) হিসেবে যে ধরনের জাতিগত বৈষম্যের চর্চা প্রতিষ্ঠানিকভাবে করা হতে থাকে তাতে করে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি অংশের একসঙ্গে বসবাস করার কোন যুক্তি ছিল না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাকিস্তানী শাসকবর্গ পরিবর্তিত হলেও শাসনের কোন চরিত্রগত পরিবর্তন সাধিত হয়নি। কাজেই এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, পাকিস্তানের ধ্বংসের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে একটি কৃত্রিম বন্ধনের মাধ্যমে এর অস্বাভাবিক অভ্যুদয়। পাকিস্তানের দুটি বৃহৎ অংশের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই অধিক ছিল। অপরদিকে বাংলায় অতি প্রচীন কাল থেকেই অনেক শক্তিশালী জাতিগত উপাদান সৃষ্টি হয়েছিল যা পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিভেদের রাজনীতির ফলশ্রুতিতে আরও শক্তিশালী হয়ে জাতিসত্তা বিকাশে প্রবল ভূমিকা রাখে। বাংলায় ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক আচরণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্টগুলোর ওপর বিকশিত শক্তিশালী জাতিসত্তাকে কোনভাবেই কোন বিদেশী সংস্কৃতি দিয়ে বা কেবল ধর্মের গোঁড়ামি দিয়ে নির্মূল করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকসুলভ আচরণ ও কর্তৃত্ব প্রবণতা এই অমিলগুলোকে দৃঢ়তর করে পাকিস্তানকে আরও বেশি ভঙ্গুর করেছে। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়টি উদারমনা ও সভ্য বাঙালীদের কাছে তাই খুব আদিম ও স্থূল বিষয় হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকেরা কখনও রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বা বাংলা ভাষা বিষয়ে এই প্রদেশের জনগণের মতামত, আশা-আকাক্সক্ষা বা উপলব্ধি সম্পর্কে কোন আলাপ-আলোচনায় এ দেশের জনগণের নেতাদের আমলে নেয়নি। অর্থাৎ তাদের সব প্রকার সিদ্ধান্তগুলো ছিল একতরফা। তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বা উন্নয়নের বিষয়ে তাদের নিজস্ব ধ্যান ধারণার বাইরে আর অন্য কোন সম্ভাবনার বিষয়ে ছিল পুরোপুরি অনড়। বাংলা ভাষাভাষীদের আবেগ, অনুভূতি, মনন এবং তাদের নিজেদের সংস্কৃতির বিষয়ে সংবেদনশীলতার গুরুত্ব এরা অনুধাবন করার চেষ্টাও করেনি বা এটাকে কোন প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবেও তাদের ধারণার মধ্যে ঠাঁই দেয়নি। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ : মি. জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, ইসকান্দার মীর্জা, আইয়ুব খান ইত্যাদির বিবেচনায় তাদের অনুগত এদেশের মধ্যম শ্রেণীর মুসলিম লীগের নেতা, নুরুল আমিন, খাজা নাজিমুদ্দিন, মোনায়েম খান, ফ কা চৌধুরীরা বাংলা ভাষার বিষয়ে বা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে কথা বলার জন্য উপযুক্ত ছিল। এরা যেহেতু বাংলার মানুষের হৃদয়ের কথা বোঝার চেষ্টা করেনি সেহেতু প্রতি পদক্ষেপেই তারা ভুল করেছে এবং এ ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপই পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে। গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের মতামতের বা ইচ্ছার বা পরিকল্পনার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে পারা বড় মাপের নেতৃত্বের গুণ। বাংলার প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলান স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন প্রকার আলাপ না করার বিষয়টি এটাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এ দেশের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাজনৈতিক ও সামাজিক এলিট শ্রেণীকেও পাকিস্তানী শাসকের দল কখনই সম্মানের চোখে দেখতো না। যারাই যখনই পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসেছেন, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী, ইসকান্দার মীর্জা, নাজিমুদ্দীন, আইয়ুব খান, ইয়াহইয়া এরা সকলেই বাংলা, এর মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতি, কোন কিছুর প্রতিই কোন শ্রদ্ধাবোধ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×