ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আট কারণে লাভের মুখ দেখছে না সরকারী পাটকল

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 আট কারণে লাভের মুখ দেখছে  না সরকারী পাটকল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দলাদলি, সময়মতো কাঁচাপাট কিনতে ব্যর্থ হওয়া, পাটের গুণগতমান ভাল না হওয়া, বেশি জনবল, সিবিএ’র দৌরাত্ম্য, পুরাতন যন্ত্রপাতি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি - এই আট কারণে লাভের মুখ দেখছে না সরকারী পাটকলগুলো। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ খাতকে উৎসাহ দেয়া হলেও সরকারী পাটকলগুলো লাভের মুখ তো দেখছেই না, উল্টো লোকসানের পরিমাণও কমাতে পারছে না। নতুন সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টাকার অভাবে অনেক পাটকল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গত ৫ বছরে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে। তারপরও টাকার অভাবে সময়মতো পাট কেনা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন নেতারা বলছেন, সরকার পাট খাতের উন্নয়নে যেসব সুবিধা দিচ্ছে, সেগুলোর সুফল আমরা পাচ্ছি না। বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সরকারী আদেশের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের ঠেকিয়ে রাখছে। ফলে আমরা দিনদিন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করছি। বারবার এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হলেও ফল মিলছে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারী পাটকল শ্রমিকদের জমানো গ্রাচ্যুইটির টাকাও খরচ করেছে পাটকল কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা অবসরে যাওয়ার সময় নিজেদের জমানো টাকা না পেয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য। দেশের চাহিদার মাত্র ২৪ শতাংশ পাটপণ্য সরকারী পাটকল পূরণ করতে পারলেও বেসরকারী পাটকলগুলো বাকি ৭৬ শতাংশ পূরণ করে বলে জানিয়েছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। বিজিএমসি’র হিসেবে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। গতবছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে দুই হাজার ৯১২ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২৮ শতাংশ পূরণ হয়নি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কাঁচাপাটের রফতানি কমেছে ৬১ শতাংশ, পাটের সুতা ২৩ শতাংশ ও অন্যান্য পাটপণ্য ৫৪ শতাংশ। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে এ হার বেড়েছে। এমনটিই জানিয়েছেন বেসরকারী পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সচিব এ বারিক খান। তিনি বলেন, ‘বেসরকারী খাতে পাটকলের সংখ্যা জুট স্পিনিং মিলসহ সব মিলিয়ে ২২২টি। সবগুলোই চলছে ভাল। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ শতাংশ রফতানি প্রণোদনা পেয়ে খুবই খুশি বেসরকারী পাটকল মালিকরা। কিন্তু সরকারী পাটকলগুলোতে এর কোন প্রতিফলন নেই।’ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত বেসরকারী একটি পাটকল। মিলগেটের দু’ধারেই নিরাপত্তারক্ষীরা দায়িত্ব পালন করছেন। সারি সারি ফুলগাছের সমারোহ আর নানা রঙের ফুল দেখে মন জুড়িয়ে যায়। ভেতরেও সুন্দর পরিবেশ। কোন মিছিল-মিটিং নাই। প্রত্যেকেই পালন করছেন নিজ নিজ দায়িত্ব। কাজ শেষে সারিবদ্ধভাবে ফিরছেন বাসায়। এমন একটি পরিবেশে কাজ করলে সবার মনই ভাল থাকে বলে জানালেন ওই পাটকলের একজন শ্রমিক। ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় আসা আবদুর রহমান নামের ওই কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় মতিঝিলে বিজিএমএ অফিসে। তার বাড়ি যশোরের নওয়াপাড়ায়। দুই ছেলেমেয়ে ও মাকে নিয়ে সংসারে সদস্য পাঁচজন। প্রতিসপ্তাহ শেষে যা পান তা দিয়েই চলে সংসার। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বেসরকারী পাটকল বলে এখানে শ্রমিকদের জন্য পেনশন ও গ্রাচ্যুইটি সুবিধা নেই। তারপরও আক্ষেপ নেই আবদুর রহমানের। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সপ্তাহে নিয়মিত মজুরি পাই। কারও কাছে হাত পাততে হয় না। এমন মনোভাব ওই পাটকলে কর্মরত সকল শ্রমিকের এমনটাই জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘এখানে কোন সিবিএ নেই। কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দলাদলি নেই। কাঁচাপাটের অভাবে পাটকল বছরে একদিনও বন্ধ থাকে না।’ অপরদিকে রাজধানীর অদূরে ডেমরায় অবস্থিত লতিফ বাওয়ানি জুটমিল। দীর্ঘদিনের পুরানো সরকারী পাটকল। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মিলের প্রধান ফটকের আশপাশে শ্রমিকদের জটলা। বকেয়া বেতনসহ অন্যান্য সুবিধার দাবিতে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয় কারখানার ভেতরে-বাইরে। যদিও বর্তমানে এমন অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। জানতে চাইলে হাসিবুল হক নামের একজন শ্রমিক জানান, অনেক সময় আমাদের সপ্তাহ আটকে (বেতন বন্ধ) যায়। কিছুদিন ঠিকমতো চললেও মাঝেমধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়। ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে থাকি। কারখানার তহবিলে টাকা নাই বলে যে শ্রমিকরা অবসরে গেছেন তারাও তাদের জমানো গ্রাচ্যুইটির বিল পাচ্ছেন না। তারাও আসেন মিলগেটে। এ বিষয়ে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলের একজন হিসাব সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘সরকারী পাটকল বলে কথা। সিবিএ না থাকলে চলবে কীভাবে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী কর্মীরাই রয়েছেন এই পাটকলে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন, মিছিল মিটিং করলে বাধা দেয়া তো যাবে না। এটি তাদের অধিকার।’ এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারী পাটকল বোঝেন না? সব প্রশ্ন করতে নাই।’ সূত্র জানায়, স্বাধীনতার আগে থেকে চলছে দেশের পাটখাত। এ খাতের জন্য ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৭৪ সালে করা অধ্যাদেশের ভিত্তিতেই চলছে পাটখাত। সংশোধিত অধ্যাদেশে পরিবর্তন, পরিমার্জনসহ কিছু সংযোজনও করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী হয়েছে এর আইন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বর্তমানে রফতানি খাতে পাটের অবদান ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এ হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিজিএমসির হিসেবে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। গত বছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে দুই হাজার ৯১২ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২৮ শতাংশ পূরণ হয়নি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানি কমেছে কাঁচাপাট ৬১ শতাংশ, পাটের সুতা ২৩ শতাংশ ও অন্যান্য পাটপণ্য ৫৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির ৬৭টি পাটকল তদারক, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজেএমসি গঠিত হয়। পরে আরও পাটকল সরকারী করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয় মোট ৮২টি পাটকল। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৪৩টি পাটকলকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার পর সরকারের হাতে থাকে ৩৮টি পাটকল। কিন্তু ১৯৯৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পাট খাত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় আরও ১১টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় গত বিএনপি সরকারের আমলে, ২০০২ সালে।
×