ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেয়াল ঢেকেছে বিজ্ঞাপনের পোস্টারে

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দেয়াল  ঢেকেছে বিজ্ঞাপনের  পোস্টারে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কমলাপুর টিটিপাড়া থেকে বাসাবো পর্যন্ত আসতে রাস্তার বাম পাশে ফুটপাথ ঘেঁষে রেলওয়ের দেয়াল। প্রায় এক কিলোমিটারের বেশি দেয়ালের সম্ভবত এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা নেই। পুরো অংশ জুড়েই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। হেন কোন পণ্যের খবর নেই এই দেয়ালে স্থান পায়নি। সিমেন্ট কোম্পানি, দাঁতের চিকিৎসা, যৌন চিকিৎসা, হোমিও চিকিৎসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইলেক্ট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে পত্রিকার বিজ্ঞাপনও আছে এখানে। দৃশ্য দেখে মনে হবে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এখন আর কোন গণমাধ্যমের প্রয়োজন নেই। শহরের দেয়াল হয়তো বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আসলেই তাই! এ তো গেল এক জায়গার খবর। এবার বাসাবো মোড় থেকে শুরু উড়াল সড়ক। সড়কের দেয়াল ও ভিম দেখার খুব একটা সুযোগ নেই। সিনেমার অশ্লীল পোস্টার, কোচিং সেন্টার, বিভিন্ন গার্মেন্টেস প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ, রাজনৈতিক নেতাদের শুভেচ্ছা, মাদকাসক্ত রোগের চিকিৎসাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর খবরে ঢাকা পড়েছে উড়াল সড়কের গা। বেশিরভাগই হাতে লেখা, আছে পোস্টারও। কিছু পোস্টার সাঁটানো হয়েছে একদম ওপরে। যা সহজেই নষ্ট করা সম্ভব নয়। এই উড়াল সড়কটির শাজাহানপুর অংশের চিত্রও ঠিক একই রকম। আরও মজার বিষয় হলো উড়াল সড়কের নিচে রোড ডিভাইডারের দেয়ালে দেয়ালেও আছে বিজ্ঞাপনের খবর। যতো খবরের প্রয়োজন ততো রকম বিজ্ঞাপন আছে। শাজাহানপুর কবরস্থানের দেয়ালসহ আশপাশের সব দেয়ালজুড়ে বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। মৌচাক মার্কেট থেকে আবুজর গিফারী কলেজের গলিতে ঢুকতে যদি হাতের বাম পাশের দেয়ালে চোখ পড়ে যায় তবে না থামে কার সাধ্য আছে। সত্যি। থেমে যেতে হবে। যারা এ পথে নিয়মিত যাতায়াত করেন তাদের প্রত্যেককেই গলিতে প্রবেশ মাত্রই একটু ধাক্কা খেতে দেখা গেছে। এক ঘণ্টার বেশি সময় প্রতিবেদক এই জায়গাটিতে অপেক্ষা করেন। দেখা গেছে শতকরা ৯০ জন মানুষকে দাঁড়াতে। দেয়ালজুড়ে হাজার-হাজার টু-লেট। গুনে শেষ করা যাবে না সংখ্যা। বাড়ি ভাড়া, সাব লেট এরকম টু-লেটের সংখ্যাই বেশি। দেয়াল প্রায় এক ইঞ্চি পুরো হয়েছে গায়ে পোস্টার লাগতে লাগতে। একটি টু-লেট সর্বোচ্চ দু’দিন থাকে। এরপরই আরেকটি পোস্টার যোগ হয়। কেউ এখানে দাঁড়ান দৃশ্য দেখার জন্য। আবার কেউ বাসা বা সাব লেট কিংবা মেস ভাড়ার প্রয়োজনে। পাশের মার্কেটের ব্যবসায়ী হাসান আলী জানালেন, প্রতিদিন রাতে দেয়ালে নতুন নতুন টু-লেট সাঁটানো হয়। আশপাশে এলাকার সব রকমের টু-লেট এখানেই আসে। অনেকের উপকারও হয়। বাসা কিংবা মেস ভাড়ার সন্ধান পেয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ছুটে যেতে পারেন। পুরো মৌচাক আর ফার্মগেট এলাকাজুড়ে আছে কোচিং সেন্টার, দন্ত চিকিৎসা, সিনেমার পোস্টারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রচারণা। ফার্মগেট এলাকার প্রতিটি গলির মুখে, দেয়ালে পোস্টার আর লিখন। আছে লাজ ফার্মার প্রচার। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যানার সাঁটিয়েছে উড়াল সড়কের দেয়ালজুড়ে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইচ্ছেমতো দেয়াল লিখন বা পোস্টার সাঁটানো যে অন্যায় তা তারা জানেন না। এই অপরাধে জেল ও আর্থিক জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে তা কখনই শোনেননি বেশিরভাগ নাগরিক। তাহলে সংকটের সমাধান কি। সবার বক্তব্য হলো, ইচ্ছেমতো পোস্টার লাগানো ও দেয়াল লিখন যে আইনসিদ্ধ নয় তা আগে নগরবাসীকে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে জানাতে হবে। ইচ্ছেমতো দেয়াল ব্যবহারে বাধা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ ও নিষেধাজ্ঞাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর সব উন্নত দেশের নগরে সৌন্দর্য বর্ধন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত বিষয়। নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় ইচ্ছেমতো দেয়াল লিখন বা পোস্টার সাঁটানো নিষিদ্ধ। এতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সব ধরনের স্থাপনার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অপরিচ্ছন্ন হয় নগর। রাজধানী ঢাকা শহরেও এরকম আইন রয়েছে। কিন্তু যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নাগরিকরা আইন সম্পর্কে সচেতন নন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিমালিকানাধীন সব ধরনের স্থাপনায় পোস্টার আর দেয়াল লিখন পাওয়া যাবে। শহর ঘুরে দেখলে মনে হবে পুরোটাই যেন বিজ্ঞাপনের নগরী। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পোস্টার অপসারণে সিটি করপোরেশন কিছুদিন কাজ করলেও আবারও নতুন করে পোস্টার যুক্ত হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় যেখানে-সেখানে পোস্টার লাগানো থেকে বিরত রাখার জন্য বোর্ড স্থাপন করেছে সংস্থাটির বর্জ্য বিভাগ। মূলত নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সিটি করপোরেশন ঢাকার অন্তত ২০ স্থানে এ রকম বোর্ড স্থাপন করে। কোন কোন স্থানে পোস্টার লাগানো যাবে এ খবরও রাখেন না কেউ। সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, নাগরিকদের বিভিন্ন প্রচারের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। তবে প্রচারের বেলায় শহরের সৌন্দর্য যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বাছাই করা হয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায় ৫২টি স্থানে পোস্টার লাগানোর জন্য বোর্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ২০ স্থানে বোর্ড নির্মাণ সম্পন্ন হয়ছে বলে জানা গেছে। সিটি করপোরেশনের দাবি, গুলশান শূটিং ক্লাব, খামারবাড়ি, উত্তরা, মিরপুর, মহাখালী, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর এলাকায় বিলবোর্ডগুলো লাগানো হয়। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ হাইকোর্ট এক আদেশে অননুমোদিত পোস্টার-ব্যানার ও তোরণ অপসারণের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে সব পোস্টার, ব্যানার ও তোরণ সরানোর নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্ট এই আদেশ দেয়ার পাশাপাশি রুলও জারি করে। হাইকোর্টের এই নির্দেশ পালনের জন্য ডিএনসিসি ঘোষণা দেয় বোর্ডের বাইরে কেউ পোস্টার লাগালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপক কমোডর আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেন, পোস্টার লাগানোর জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিভিন্ন এলাকায় ২০ নির্ধারিত জায়গা রয়েছে। তার পরও মানুষ ইচ্ছামতো যেখানে-সেখানে পোস্টার লাগায়। এত কিছুর পরও মানুষকে খুব বেশি সচেতন করা যায়নি। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি নগর পরিচ্ছন্ন রাখার। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদগেটে ফুটপাথের ওপরে ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জিনিসপত্র রাখার একটি কক্ষের দেয়ালে স্টিলের কাঠামো দিয়ে পোস্টার লাগানোর জায়গা করা হয়েছে। কাঠামোর ওপরে পোস্টার লাগানোর জন্য ডিএনসিসি আহ্বান করেছে, পাশাপাশি আইন না মেনে পোস্টার লাগানোর শাস্তি সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। তার পরও নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর বিষয়ে সচেতনতা কম। অথচ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিনামূল্যে এই পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখানে পোস্টার লাগানোর জন্য কোন ভাড়া কিংবা অর্থ খরচ করতে হবে না। আসাদগেট ছাড়াও মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, মানিক মিয়া এভিনিউয়ে টিএ্যান্ডটি মাঠের পাশে, ফার্মগেট, মিরপুর টোলারবাগ আবাসিক এলাকা, মিরপুর-১ রাইনখোলা মোড়, প্রগতি সরণির কোকাকোলা মোড় ও নিকেতন এলাকায় ডিএনসিসির পোস্টার লাগানোর স্ট্যান্ডগুলো কার্যত খালি পড়ে আছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেয়াললিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোন দেয়ালে বা স্থানে পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ। আইনভঙ্গ করে কেউ যত্রতত্র দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে এর সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা এবং অনুর্ধ ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- আরোপ করা হবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- দেয়া যাবে। এ ছাড়া ওই সুবিধাভোগীকে তার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন, পোস্টার মুছে ফেলার বা অপসারণের জন্য আদেশ দিতে পারবেন আদালত। এ বিষয়ে কমোডর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা অতীতে এ নিয়ে কাজ করেছি। তবে নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিয়েছিল; কিন্তু নাগরিকদের নিজেদের সিটি নিজেদেরই পরিষ্কার রাখতে হবে। আমরা নগরবাসীকে আহ্বান জানাব নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর। রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, খিলক্ষেত, গুলশান-১, ২, মহাখালী, বনানী, চেয়ারম্যানবাড়ী, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, কলেজগেট, আসাদগেট, টেকনিক্যাল, গাবতলী, মিরপুর-১ ও ১০, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, ধানম-ি, পান্থপথ, গ্রীন রোড, সাইন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, আজিমপুর, এ্যালিফেন্ড রোড, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, কাঁঠালবাগান, শাহবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, পল্টন, নয়া পল্টন, কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, মতিঝিল, ইত্তেফাক মোড়, টিকাটুলি, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সদরঘাট, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারের চিত্র চোখে পড়ে। মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা রশিদ বলেন, মানুষ তার যে কোন প্রচারণার জন্য দেয়াল বেছে নিচ্ছে। নিজের খেয়াল খুশিমত দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হচ্ছে। দেয়াল লিখন হচ্ছে। কেউ বাধা দেয়ার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা সুমন বলেন, অফিসে যাওয়াও সময় রাস্তায় এক ধরনের পোস্টার। ফিরতে পথে আরেক রকম। অর্থাৎ ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে যুক্ত হচ্ছে। খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, মৌচাক-মালিবাগ-মগবাজার, ঢাকা মেডিক্যাল এলাকা, কুড়িলসহ যেখানে যেখানে উড়াল সড়ক আছে সবখানেই আছে পোস্টার আর লেখালেখির দাপট। পোস্টারের কারণে উড়াল সড়কের পিলারের গা কোথাও কোথাও দেয়াল পর্যন্ত দেখার সুযোগ নেই।
×