ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয় ॥ দুদক চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: ১০:২৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতি দমন সম্ভব  নয় ॥ দুদক চেয়ারম্যান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার মাধ্যমে তাদের লোভের জিভ্্ কেটে ফেলা হবে বলে মন্তব্য করেছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে দুদকের কৌশলপত্রের ’১৯ ওপর ‘মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ’ শীর্ষক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। দেশের ৩০ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভা হয়। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) সারোয়ার মাহমুদ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দুদক সচিব দিলোয়ার বখত, মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী ও মহাপরিচালক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক হয়তো কাক্সিক্ষত মাত্রায় দুর্নীতি কমাতে পারেনি এবং একক কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতি দমন কমাও সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। দুর্নীতির উৎস বন্ধেও সরকারের কাছে সুপারিশের আইনী দায়িত্ব দুদকের রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জনহয়রানি রোধে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পাঠানো হচ্ছে। মূলত রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়, বিষয়টি দলগুলো অনুধাবন করেই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের বিষয় প্রাধান্য দিয়েছে। তবে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, তবে এক দিন বা এক বছরেই দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন দুদক চেয়ারম্যান। একসময় বলা হতো অর্থই অনর্থের মূল, কিন্তু সবসময় অনর্থের মূল নয়। অনেক সময় অর্থই অর্থের মূল। অর্থ মানেই ক্ষমতা। অর্থের পেছনে ছুটে মানুষ। এটাতে তারা এখন আর লজ্জা পায় না, তাই দুর্নীতিবাজদের লজ্জা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা ও উন্নয়নের প্রয়োজন। তিনি বলেন, দুদককে ভয় পায়নি এমন লোক হয়তো সমাজে নেই। তবে ভয় দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না। ইকবাল মাহমুদ বলেন, সব দুর্নীতিই দুদকের ম্যান্ডেটভুক্ত নয়। দন্ডবিধির কয়েকটি ধারা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন দুদকের তফসিলভুক্ত। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির চেয়ে স্কুলের দুর্নীতিই দুদকের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, দুদক পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি দেখবে, না স্কুলের দুর্নীতি দেখবে? আমার মনে হয়, স্কুলটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা জাতির ভবিষ্যত ধ্বংস করে, এটা সবটাই যার যার দর্শনের বিষয়। সব দুর্নীতি দুদকের ম্যান্ডেট না উল্লেখ করে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দুদকের মূলত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি দেখার কথা। তবে আমরা সরকারকে সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ দিতে পারি। আমরা একটি এথিক্যাল কোড অব কন্ট্রাক্ট তৈরির চেষ্টা করছি। যেটা সরকারের হাতে তুলে দেব। দেশব্যাপী বাস্তবায়ন হবে। দুর্নীতি করে কারও পার পাওয়ার সুযোগ নেই- এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা চাই একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দিতে। দুদককে ভয় পায় না সমাজে এমন লোক নেই। এটা আমরা করতে পেরেছি। ’১৮ সালে ৬৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ৬৮ শতাংশ। এটাকে আমরা পজিটিভ হিসেবে দেখছি। দুর্নীতি কমে যাচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। একটা সচেতনতা বৃদ্ধি হচ্ছে। তবে এটা এমন নয় যে একটা কল বসালাম আর সঙ্গে সঙ্গে পানি পাব। আমেরিকান স্টাইলে জাম্প করে পরিবর্তন আসবে, এমনটা আশা করা ঠিক হবে না। দুদকের মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হলে স্পেশাল কোর্ট প্রয়োজন জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সবকিছুর উর্ধে হচ্ছে রাজনীতি, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া কিছুই সম্ভব না। আশার কথা হচ্ছে, এবার নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে। মানুষ দুদকের ওপর আস্থা রাখছে, এটা পজিটিভ। তবে কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। যে মাত্রায় দুর্নীতি কমার কথা, সে মাত্রায় কমেনি। শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যারা পরিচিত দুর্নীতিবাজ, তাদের তালিকা করছি। তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত ও সম্পদের বিবরণ সংগ্রহ করছি। তাদের ছাড় দেয়া হবে না। বেসিক ব্যাংক প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বেসিক ব্যাংকের কি হলো? আমরা সেখান থেকে ১৫শ’ কোটি টাকা আদায় করেছি। এটাই তো একটা কাজ। আপনারা বলেন, বেসিক ব্যাংকের চার্জশীট দেন না কেন? এগুলোও আমাদের স্ট্র্যাটেজিতে আছে। সময়মতো দেয়া হবে। এটা এমন নয় যে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকাররা যদি সঠিকভাবে কাজ করেন, তাহলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে। ব্যাংক ঋণ দেবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু ঋণ যেন ব্যাংকিং নিয়ম মেনে দেয়া হয়। যদি তা মানা না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুদক চেয়ারম্যানের সূচনা বক্তব্যের পর মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত ও পরামর্ম তুলে ধরেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না রিফাত বলেন, দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন কোন পদ্ধতি নেই, যার সাহায্যে দুর্নীতি করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামস আসিফ চৌধুরী বলেন, দুদক স্কুল পর্যায়ে সততা সংঘ গঠন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের কোন সংগঠন নেই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এথিকস ক্লাব গঠনের আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্পিতা মহাজন বলেন, আইনী সংস্কার ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং তাৎক্ষণিক ফল চাই। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টোটন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, যারা দুর্নীতি করেন তাদের ভয় ও লজ্জার ব্যবস্থা করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান বলেন, অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা না গেলে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। তিনি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। শেকৃবি শিক্ষার্থী মিরা রহমান বলেন, খাদ্যে ভেজাল দুর্নীতি। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা এই দুর্নীতি করছে এবং তারাই নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন বলেন, কৃষি ভর্তুকির অর্থ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি হয়। আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান মিয়া বলেন, আমরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি কিনা এটি বড় প্রশ্ন। দুর্নীতি একটি চেন অপরাধ। নিচের দিকে কর্মকর্তারা জানেন, উর্ধতন কর্মকর্তারাও দুর্নীতিপরায়ণ। তাই দুর্নীতি করলে কিছু হবে না। জাবি শিক্ষার্থী শম্পা গুহ বলেন, পদ্ধতিগত কারণেই দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য।
×