ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতে ভেতরে ভেতরে গণপদত্যাগের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

জামায়াতে ভেতরে ভেতরে গণপদত্যাগের প্রস্তুতি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে গণহত্যায় জড়িত থাকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও সংস্কার ইস্যুতে দলে গণপদত্যাগের আশঙ্কা করছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব। জামায়াত-শিবিরের নবীন এমনকি প্রবীণদেরও একটি বৃহৎ অংশ সম্পৃক্ত হয়ে কেন্দ্রকে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন-এমন তথ্য আসার পর জারি করা এক নির্দেশনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অস্থিরতা সামাল দেয়ার চেষ্টায় ‘দায়িত্বশীল ছাড়া কারও ডাকে সাড়া নয়’ বলে সারাদেশের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আদেশ জারি করা হলেও একে বৃথা চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করছেন প্রতিবাদকারিরা। এ ধরনের আদেশ জারি করা নিয়েও প্রশ্ন তুলে নেতারা বলেছেন, সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার আছে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। সংস্কারের দাবি তোলার প্রেক্ষাপটে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও অবস্থানে অটুট আছেন ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি জামায়াতের ঢাকা মহানগর মজলিসে শূরার অন্যতম সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জু। সারাদেশের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জারি করা নির্দেশের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, জামায়াত একটি সুসংগঠিত সংগঠন। সব সিদ্ধান্ত আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, অঞ্চল দায়িত্বশীল, জেলা ও মহানগর আমিরদের মাধ্যমে জানানো হবে বলে এমনিতেই বলা আছে। এটা সব সময়ের জন্যই। কিন্তু এখন এটা কেন আলাদা করে নির্দেশনা জারি করতে হলো তা যারা জারি করেছেন তারাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের আদেশ জারি করায় সন্দেহ হবেই। সংস্কারের দাবি তুলে দলে এক শ্রেণীর নেতার বিরাগভাজন হয়ে বহিষ্কৃত হওয়া এ নেতা জনকণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল আমি যেন পদত্যাগ করি। দল ও দলের বাইরে আমার যারা ওয়েল উইসার আছেন তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি না। আমি সংস্কারের দাবিতে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছি। দলের বিপুল জনসমর্থন আছে একই দাবিতে। আমি পার্টিকে ধারণ করে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু পার্টি আমাকে চায়নি। আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং দলের বিষয়ে আমার এখন কোন দায়বদ্ধতা নেই।’ জামায়াত-শিবিরের সূত্রগুলো বলছে, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগ ও সংস্কারের পক্ষে তার খোলামেলা বিবৃতিসহ একাধিক ঘটনা শীর্ষ নেতাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগের পর দলে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় নেতা ও ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকেও দলে থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার দিনাজপুর জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে জামায়াতের এক আমির বখতিয়ার উদ্দিন পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন শীর্ষ নেতারা। ইতোমধ্যেই দলটির পরামর্শসক হিসেবে কাজ করছেন এমন বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন জামায়াত নেতারা। তবে জামায়াতের পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে যারা কাজ করছেন তারা অধিকাংশই সংস্কার ও ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুতে নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে দলটি একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইবে না বলেই জানিয়েছেন একাধিক নেতা। এমনকি সংস্কার ইস্যুও নিয়েও দলে যাতে বড় ধরনের অস্থিরতা না হতে পারে সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে দলটি। জামায়াতের অন্যতম পরামর্শক হিসেবে পরিচিত সাবেক সচিব শাহ আব্দুল হান্নান ইতোমধ্যেই বলেছেন, ‘জামায়াতের মধ্যে কোন সংস্কার হয়নি এমন বক্তব্য সঠিক নয়।’ পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী আর বাংলাদেশ জামায়াত এক নয় বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বর্তমান জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার সময়ের ভূমিকার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়’। জানা গেছে, দলের কোন ধরনের সংস্কারের বিরোধিতা করা কিংবা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে এমন নেতারা মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে বোঝানোরও চেষ্টা করছেন। সংস্কারের দাবি তোলা নেতাকর্মীদের সামনে তারা একটি ব্যাখ্যাও দার করিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, সংগঠনকে গ্রহণযোগ্য করতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ক্ষমা চাওয়া একটি বিবেচ্য বিষয় এটা ঠিক। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের মান ও মর্যাদা যুক্ত। ক্ষমা চাইলে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি একাত্তরের ভূমিকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে সরকার সংগঠন ও নেতাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইনী পদক্ষেপ নেয়া সহজ হয়ে যাবে বলেও উল্লেখ করছেন শীর্ষ নেতারা। এসব ব্যাখ্যার বাইরেও সংগঠনে যেন বড় ধরনের প্রতিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সেজন্য শক্ত অবস্থান নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন জামায়াতের পরামর্শকরা। তবে সংস্কার ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিতে শীর্ষ নেতাদের নেতিবাচক অবস্থানের বিষয়টি জানার পর মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র শিবিরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুর বহিষ্কারের ঘটনা ছড়িয়েছে বাড়তি ক্ষোভ। ঠিক এমন অবস্থায় সারাদেশে নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে গণপদত্যাগ করতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন নেতারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় জারি করা এক আদেশ নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সংস্কারের দাবি তোলা নেতাকর্মীদের মাঝে। যেখানে বলা হয়েছে, দলের সব সিদ্ধান্ত আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, অঞ্চল দায়িত্বশীল, জেলা ও মহানগর আমিরদের মাধ্যমে জানানো হবে। এর বাইরে কারও ডাকে সাড়া না দিতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক অধিবেশনে নেয়া দুই পৃষ্ঠার নির্দেশনার একটি সতর্কবার্তা নেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, অঞ্চল দায়িত্বশীল এবং জেলা ও মহানগর আমিরদের মাধ্যমে যথা সময়ে সরাসরি জানানো হবে। এর বাইরে কারও আবেদন, নিবেদন ও অনুরোধে কোন জনশক্তি (নেতাকর্মী) যাতে সাড়া না দেয় সে বিষয়ে সবাইকে সর্তক থাকতে হবে’। দল থেকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগে জামায়াত মর্মাহত উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘দীর্ঘদিন তিনি এই সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে আইন অঙ্গনে সংগঠনের কঠিন সময়ে অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা অতীতে তার সব অবদানকে সম্মানের চোখে দেখি।’ মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দল থেকে বহিষ্কারের কারণ ব্যাখ্যা করে চিঠিতে বলা হয়, ‘তিনি গত কয়েক বছর থেকে সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে ভিন্ন মতপ্রকাশ করে আসছিলেন। একাধিকবার সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকা- পরিহার করার জন্য তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। তিনি গত কয়েক বছর ধরে ভিন্ন একটি সংগঠন গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিলেন উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সম্প্রতি মঞ্জু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের নিয়ে বৈঠকে সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজ দায়িত্বে একটি সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা করেন যা সংগঠনের রীতিনীতি ও নিয়ম শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যদিও তার এই উদ্যোগে সংগঠনের কঠিন দিনের সহকর্মীরা তেমন সাড়া দেননি। ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার বৃহত্তর স্বার্থে তার সদস্যপদ মুলতবি করে পদ বাতিলের জন্য দলের আমির বরাবর সুপারিশ করা হয়েছে যা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য বিবেচনাধীন। জানা গেছে, মজিবুর রহমান মঞ্জু ছাত্র শিবিরের দ্বিতীয় সভাপতি যাকে জামায়াতের সংস্কার চাওয়ায় বহিষ্কার করা হলো। এর আগে ১৯৮২ সালে শিবিরের সাবেক সভাপতি আহমদ আবদুল কাদেরকে সংগঠন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই কমিটির সেক্রেটারি ফরীদ আহমদ রেজাকেও সরে যেতে হয়েছিল। দল থেকে সদ্য পদত্যাগ করা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন বলে বলছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এবার দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে যেতে সংস্কারের বিপরীতে আটলে দল অস্তিত্ব হারাবে বলেও মত দিয়েছেন নেতাকর্মীরা। আদেশ জারির পর ইতোমধ্যেই স্বোচ্চার হয়েছেন জামায়াতের তরুণসহ বহু প্রবীণ নেতাও। জামায়াত ও শিবিরের ফেসবুক পেজগুলোতেও স্বোচ্চার তারা। অনেকে ক্ষমা না চাওয়ার পক্ষে থাকলেও সংস্কার ও বহিষ্কারের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ অব্যহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে। বিষয়টিকে ‘চিন্তার কারণ’ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় মসলিশে শূরার এক সদস্য সোমবার দুপুরে জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘শীর্ষ কয়েক নেতা ও কয়েক পরামর্শকের খপ্পরে পড়েছেন নেতারা। তারা দেশের বাস্তবতা অনুসারে চলার বিপক্ষে। এটা দলের জন্যই বিপদের কারণ হবে বলে মত তার। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, দেখেন দলের অস্থিরতা নিয়ে আমরা অনেকেই এখন বেকায়দায় আছি। আশাকরি দলের স্বার্থে শীর্ষ নেতারা তাদের চিন্তার পরিবর্তন করবেন। এটা আমাদের চাওয়া। কারও বহিষ্কার কিন্তু দাবিকে দুর্বল করবে না। আদেশ দিয়েও কিছু হবে না। এসব চিন্তার পরিবর্তন আনতে হবে।’ সংস্কার চেয়ে বহিষ্কার হওয়া মজিবুর রহমান মঞ্জু ইতোমধ্যেই বলেছেন, জামায়াতের ভেতর অনেকেই দলে সংস্কারের জন্য উদগ্রীব, তাদের অনেকেই ১৯৭১ এ দলের বিতর্কিত ভূমিকা স্পষ্ট করে সামনে এগুনোর পক্ষে। আমি সেটা সাহস করে বলেছি, অনেকে সেটা বলতে পারেন না। বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমি আশাবাদী আমাদের এই দাবি দল অনুধাবন করবে, এটা হবেই। সোমবার সন্ধ্যায় মজিবুর রহমান মঞ্জু জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘সংস্কারের দাবি কিন্তু নতুন নয়। আমাদের সিনিয়র নেতারা বহু আগেই একথা বলেছেন। কিন্তু হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে বলা হলো আমি নাকি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছি। মেনে নিলাম শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য আমাকে বহিষ্কার করলেন। কিন্তু আমি যেটা বলেছি সেই সংস্কারের দাবি সঠিক কিনা সেটার উত্তর কি? আমি মনে করি সংস্কারের দাবিকে দলে বিপুল জনসমর্থন আছে। আজ না হয় সংস্কার করলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এটা করতে বাধ্য হবে দল তখন সেটা আর ভালভাবে হবে না। তখন দল উপকৃতও হবে না। এখন করলে সকলে সেটা গ্রহণও করতেন। আমাদেরও দল থেকে বহিষ্কার হতে হত না। আমিতো দলের সঙ্গে থেকে কাজ করতে চেয়েছি। সংস্কার ইস্যুতে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না এটা ঠিক নবীন আর প্রবীণের দ্বন্দ্ব নয়। এখানে মিক্স আছে। নবীন ও প্রবীণ দুপক্ষই আছে। ফেসবুকে দেখবেন অনেক নবীনও আছেন যারা সংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আবার প্রবীণরাও সংস্কারের পক্ষে আছেন। বিপুর সমর্থন আছে দাবির পক্ষে। যেখানে নবীন ও প্রবীণ দুদিকের নেতাকর্মীই আছেন’।
×