ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার বছর পর অভিজিত হত্যা মামলার চার্জশীট

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

চার বছর পর অভিজিত হত্যা মামলার চার্জশীট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দীর্ঘ প্রায় চার বছর পর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী ড. অভিজিত রায় হত্যা মামলার চার্জশীট চূড়ান্ত করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটিটিসি)। হত্যার সঙ্গে বারো জনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জনের নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে এক আসামি নিহত হয়েছে। এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট চার্জশীটে ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পলাতকদের নাম ঠিকানা পাওয়া গেলে বা গ্রেফতার করা সম্ভব হলে তাদের যুক্ত করে সম্পূরক চার্জশীট দেয়া হবে। ছয় আসামির মধ্যে বহুল আলোচিত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কথিত নেতা সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও কারাবন্দী উগ্রপন্থী ব্লগার শিবিরের সাবেক নেতা সফিউর রহমান ফারাবীও আছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের মামলাটির চার্জশীট আদালতে দেয়ার আগে অনুমোদনের জন্য সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর পূর্ণাঙ্গ দলিলসহ তা আদালতে দাখিল করা হবে। এই নিয়ে লেখক, প্রকাশক, ব্লগারসহ এ ধরনের ৫১ হত্যাকা-ের ঘটনার মধ্যে পনেরোটির চার্জশীট দাখিল হতে যাচ্ছে। সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সিটিটিসির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, ’১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাবির টিএসসির সামনে জঙ্গীদের হাতে নৃশংসভাবে ঘটনাস্থলেই খুন হন অভিজিত রায়। জঙ্গীরা যখন চাপাতি দিয়ে অভিজিতকে আঘাত করছিল, সে সময় বাধা দিতে গিয়ে বন্যার বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলটি চাপাতির কোপে কেটে পড়ে। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ঘটনার পরদিন শাহবাগ মডেল থানায় অভিজিত রায়ের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার রায় অজ্ঞাতনামা খুনীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে তদন্তের জন্য স্থানান্তর হয়। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদের তদন্তে হত্যাকা-ে মোট ১১ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। আটকদের জবানবন্দী, প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ ও নানা তথ্য প্রমাণ পর্যালোচনায় হত্যাকা-টির মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত পলাতক ‘মেজর জিয়া’ চিহ্নিত হয়েছে। এর বাইরে শফিউর রহমান ফারাবী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিত রায় হত্যায় প্ররোচনা দিয়েছিল। এজন্য তাকেও এ মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে। আটকদের মধ্যে মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, আরাফাত রহমান ও আবু সিদ্দিক সোহেল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তারা অপারেশন, ইন্টেলিজেন্স ও ট্রেনিং-এই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে এই হত্যাকা- ঘটায়। চার্জশীটভুক্ত আসামি যারা ॥ পলাতক চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। এর সাংগঠনিক নাম সাগর ওরফে ইশতিয়াক ওরফে বড় ভাই। মোঃ মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার। মোঃ আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব। মোঃ আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস। আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আব্দুল্লাহ ও সফিউর রহমান ফারাবী। এই ছয় জনের মধ্যে জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির পলাতক। বাকি চারজন কারাগারে। আসামিদের মধ্যে ফারাবী ছাড়া বাকি সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গী। পলাতক পাঁচ ॥ পলাতক পাঁচ জনের সাংগঠনিক নাম জানা গেলেও আসল পরিচয় বা ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বাকি পাঁচজনের নামও যুক্ত করে চার্জশীট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এদের নাম ঠিকানা পাওয়া গেলে বা গ্রেফতার করা সম্ভব হলে তাদের বিষয়ে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করা হবে। গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের প্রকাশ করা হয়নি। চার্জশীট থেকে ৭ জনের অব্যাহতি ॥ সাদেক আলী ওরফে মিঠু, মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান ওরফে গামা, আমিনুল মল্লিক, মোঃ জাফরান হাসান, জুলহাস বিশ্বাস, মান্না ইয়াহিয়া ওরফে মান্নান রাহি ও মোঃ আবুল বাশার। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত আসামি ॥ ’১৬ সালের ১৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয়া দলটির অন্যতম নেতৃত্বদানকারী জঙ্গী মুকুল রানা ওরফে শরিফুল। সংগঠনে হাদি নামে পরিচিত ছিল। যেভাবে হত্যাকা- ঘটেছিল ॥ বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এই লেখক জঙ্গীদের হুমকির মুখে ছিলেন। ২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের ১৫ থেকে ২০ গজ অদূরে যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় জড়িত অভিজিত রায়কে (৩৮) মাথায় কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গীরা। কে এই মেজর জিয়া ॥ পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তাকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশ পুলিশের তরফ থেকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তার পিতার নাম সৈয়দ মোঃ জিল্লুল হক। বাড়ি মৌলভীবাজার সদর জেলার মোস্তফাপুর গ্রামে। পাসপোর্ট নম্বর-এক্স ০৬১৪৯২৩। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরফ থেকে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানানো হয়, সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাত করার চেষ্টা করেছিল। তখনই প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নাম ব্যাপক আলোচনায় আসে। এ দু’জন সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়। জিয়াকে ধরতে সেই সময় পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় জিয়ার শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। রাজধানীর কয়েকটি স্থানেও জিয়ার খোঁজে চলে অভিযান। মেজর জিয়ার শাশুড়ি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হামিদা বেগম সেই সময় গণমাধ্যমকে জানান, জিয়া পটুয়াখালীর বাসায় কখনো আসেনি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে হালনাগাদ এ ধরনের ৫১টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৭২ জন জড়িত বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এরমধ্যে গ্রেফতার হয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে ৫৮ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। সর্বশেষ অভিজিত রায় হত্যার মামলা দিয়ে মোট ১৫টি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। আরও বেশ কিছু মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে।
×