ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ট্রাফিক শৃঙ্খলা এবং হতাশার চিত্র!

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ট্রাফিক শৃঙ্খলা এবং হতাশার চিত্র!

এটা নাকি ছিল ডিএমপির ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ! রাস্তায় না বের হলে বুঝতেই পারতাম না। আমি যেহেতু পরিবারের একমাত্র বাজার সওদাগর, সুতরাং ব্যাংক, বাজার, ওষুধ, ঘরের নানা সামগ্রীর পরিবর্তন, সংযোজন এবং মেরামতকরণের সংসারী মানুষের যাবতীয় কাজ সারতে প্রায় চর্কির মতো ঘোরাঘুরি করতে হয়, সেহেতু এই বিপুল কর্মযজ্ঞের শুরুর দিন থেকেই ট্রাফিকের অবস্থা দেখে চরম হতাশ হলাম। দেখলাম, সেই অযান্ত্রিক নন-ডিজিটাল ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা, যা সবাই দেখেছেÑ হাত তুলে ট্রাফিককে যেতে বলা এবং যেতে নিষেধ করা! অথচ, পৃথিবীর সব দেশের মতো সিগন্যাল বাতি কোন কোন মোড়ে জ্বলছে, নিভছে দেখেছি, যার কোন কার্যকর ব্যবহার ট্রাফিক সপ্তাহেও ট্রাফিক পুলিশ করেনি! হায়, সেলুকাস অদ্ভুত আমার স্বদেশের পুলিশ। তাদের হাত তুলে যান নিয়ন্ত্রণের আদিম ব্যবস্থার প্রতি এত আনুগত্য দেখে কয়েকবার মোড়ে, ‘এই পুলিশ শোনেন, হাত তোলেন কেন, সিগন্যাল বাতি ব্যবহার করছেন না কেন?’ বলার চেষ্টা করে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশ মনে হয় প্রতিজ্ঞা করেছে- ডিজিটাল হতে দেবে না তারা ঢাকার রাজপথকে! এটা কি শেখ হাসিনার প্রচেষ্টাকে ইচ্ছাকৃত ভ-ুল করা? এটা কি পুলিশের ক্ষমতা প্রদর্শনের পন্থা- যা তারা যন্ত্রের হাতে তুলে দিতে চায় না? আমি তো প্রায়ই রিক্সায় চড়ি এবং প্রায়ই লাল বাতি জ্বলার সময় পুলিশের হাত মোড় পার হওয়ার নির্দেশ দেয়, এ দৃশ্য প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি। অথচ, এ সপ্তাহের আগে, পথ-ঘাট দুপাশেই লাইট মেনে চলেছে এবং তখন যানবাহনের এমন দীর্ঘ লাইনও দেখিনি! পুলিশ হাত দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার ফল প্রতিবারের মতো এবারও রাজপথের একটি লেন- আসবার অথবা যাবার দীর্ঘ যানের লাইনে ভর্তি থাকতে দেখেছি, যেটি শুধু সিগন্যাল বাতির লাইট মেনে চললে কখনও ঘটতে দেখিনি। এবারে নন-ডিজিটাল আদিম ব্যবস্থায় যান চলাচল নিন্ত্রয়ণ করতে দেখে বিদেশীদের কাছে রাজপথের যান নিয়ন্ত্রণে যে বাংলাদেশ শূন্য স্কোর পাবে, তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে বলে মনে হয়। জানি না, সংসদীয় কমিটি রাজপথের যান নিয়ন্ত্রণকে অ-যান্ত্রিক থেকে যন্ত্রিক পদ্ধতিতে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন কি-না। তবে, স্মরণ রাখতে হবে- পুলিশের হাত দিয়ে যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এসডিজি অর্জনকে সুদূর পরাহত করে দিয়েছে- এতে কোন সন্দেহ নেই। দেশের বর্তমান অপরাধমূলক কাজের বৃদ্ধিতে আমার সন্দেহপ্রবণ মনে কতগুলো প্রশ্ন তুলেছে- ১. মনে হয় দূর থেকে কেউ দেশকে, মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারকে দুর্বল করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। যেটি বাস্তবায়ন করছে অর্থ-লোভী খুনী-ধর্ষক চরিত্রহীন লুটেরা, মানুষ ও ব্যবসায়ীরা যাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিন্দুমাত্র আবেদন নেই। ২. মনে প্রশ্ন জাগছে, আকস্মিকভাবে কেন ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ ও হত্যা এত বেড়ে গেল? বিশেষত নির্বাচনের পর কেন এসব অপরাধ এত বেশি বেশি হচ্ছে? শিশু অপহরণ, ছাত্র, ছাত্রী অপহরণ ও হত্যা নির্বাচনের পর এ দুই মাসে সংখ্যায় এত বেড়ে গেল কেন? ৩. প্রায়ই দেখছি, মফস্বলের কোন না উপজেলা, গ্রামে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের রাজনীতি করা প্রৌঢ়, তরুণ খুন হচ্ছে- কেন? এ অবস্থায় কেন প্রায় ২০০১ থেকে ৬-এর সেই জামায়াত-বিএনপি এবং খালেদা-তারেকের শাসনকালে যখন প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী খুন হচ্ছে, সেরকমটি ঘটছে কেন? এমন কি সে সময় বামপন্থী নেতাও খুন হয়েছে বাংলা ভাই গং-এর হাতে। এখনও কি নেপথ্যের কারও নির্দেশে এই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা খুন হচ্ছে? তা না হলে, বিরোধী রাজনীতি করা মানুষ, এমন কি যুদ্ধাপরাধীদলের রাজনীতি করা মানুষ তো খুন হচ্ছে না! কেন গোয়েন্দারা এই হত্যার ছকটির রহস্য উদ্ঘাটন করছেন না? আশা করি শীঘ্রই করবেন। ৪. তাছাড়া, প্রায় প্রতিদিন প্রধানত রাজধানী, এর আশপাশে, দেশের অন্য জেলায়ও কোন না কোন তুলা, সুতার গুদাম বা বস্ত্র কারখানা বা গার্মেন্টে, পাট গুদাম, পোশাক কারখানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে কেন? এর মধ্যে একটি পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যায় যেটি বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে, আবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রথম সরকার গঠনের পরপর দেখা গেছে যে, একটি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্র দেশের নানা রফতানি পণ্যের গুদাম, কারখানায় আগুন দিয়ে নাশকতা চালিয়েছে। এরাই কখনও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনায় যেমন নানা বাধা-বিঘ্ন-নাশকতা এবং প্রায়ই বার বার অগ্নিসন্ত্রাস করেছে, উন্নয়ন কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে জাতি ও দেশের উন্নয়নের বিরোধিতাও করেছে! আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এ দেশের বড় উচ্চশিক্ষিত একটি সুশীল সমাজ বিএনপিকে, বলা চলে, বিএনপি নেতা-নেত্রী, বিশেষত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিগত বাইশ বছরে সরকারে থেকেও, আবার বিরোধী দলে থাকাকালেও শত শত হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা ছুড়ে যানচালক, যাত্রী হত্যা, নাশকতামূলক অপকর্ম করতে দেখেও তাদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে আওয়ামী লীগ ও তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে সবসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করায়! এর ফলে কার লাভ হয়? অবশ্যই দেশের ফৌজদারি অপরাধকে রাজনীতি নামকরণ করে বছরের পর বছর খালেদা ও তারেককে এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে দেশের রাজনীতিকে একদিকে খুনী হত্যাকারী ধর্ষক ও চরম দুর্নীতিবাজ অপরাজনীতিকদের হাতে বার বার তুলে দিয়ে দেশের, জাতির, রাজনীতির এবং যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল, সে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের জন্ম শত্রুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে এক অব্যাহত লড়াইয়ের অশুভ জন্ম দিয়েছে! তারা প্রকৃতপক্ষে জিয়া, খালেদা, তারেকের চাইতে কম অপরাধ করেনি। কেননা, তাদের এবং দুটি প্রিন্ট মিডিয়ার দীর্ঘকালীন এই অশুভ চক্রকে সমর্থন দান তাদের ফৌজদারি অপরাধকে রাজনীতি গণ্য করার সুযোগ বা ভুল করার পথে পরিচালনা করেছে! তাদের সমর্থন ছাড়া খালেদা, তারেক এবং জঙ্গীরা, যুদ্ধাপরাধী দল সবাই জীবন্মৃত হয়ে ক্রমশ শক্তিহীন ও দুর্বল হয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার ক্ষেত্র থেকে কবেই হারিয়ে যেত! এ অভিজ্ঞতাও আমাদের একটা শিক্ষা দেয় যে, আমাদের রাষ্ট্রের জনক এবং মহানায়কের জন্মের পাশাপাশি যে দুষ্টচক্র যুদ্ধাপরাধীদের জন্ম হয়েছিল, তাদের বাঁচিয়ে রেখে ও দেশকে চির অস্থিতিশীল করে রাখার জন্য দেশী-বিদেশী চক্র সুকৌশলে জিয়া, খালেদা ও তারেকের উত্থান ঘটিয়েছিল একেবারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার নীলনক্সার ছক কেটে! এখন সময় এসেছে- এই দেশ ও জাতির উন্নয়নের শত্রু, অপরাজনীতিকদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশের রাজনীতিকে দেশপ্রেমভিত্তিক শুদ্ধ, ষড়যন্ত্র হীন, সুশাসনের জন্য গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার গভীর বিশ্বাস, আমাদের দেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্ম দেশের, জাতির এবং মুক্তিযুদ্ধের শত্রু কে, মিত্র কে, তা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করেছে। এখন ওরাই ওদের দেশকে শত্রুমুক্ত রাখবে। আশা করি, সামনের দশকে দেশ এই শত্রুদের কবল থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা পাবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×