ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি এখন মরা খাল

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি এখন মরা খাল

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো-বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে’। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের অমর সৃষ্টি ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় উঠে আসা নদী ধানসিঁড়ি। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি থেকে রাজাপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার বয়ে চলা নদীটির দুই পারের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবি তার কবিতার মধ্য দিয়ে আবারও শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ধানসিঁড়ি নদী তীরে। অথচ কবির আরাধ্য সেই ধানসিঁড়ি আজ মরা খাল। দিনে দিনে নাব্য হারিয়ে শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হয়ে এটি ধুঁকছে অস্তিত্ব সঙ্কটে। সময় মতো খনন না হওয়া, অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া, পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ধানসিঁড়ির দৈর্ঘ্য এখন চার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এই অংশটুকুতে কোনক্রমে পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এক সময়ের খর¯্রােতা ধানসিঁড়ি। বর্ষায় কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হলেও শীত মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে প্রাণহীন হয়ে পরে রূপসী বাংলার এই নদী। দূর-দূরান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী আজও কবির প্রিয় ধানসিঁড়ি নদী দেখতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সূত্র মতে, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে গাবখান চ্যানেল ও বিষখালী নদী শুরু হয়েছে। এই তিন মোহনা থেকে উত্তর-পশ্চিমে বয়ে চলা জলধারার নাম ধানসিঁড়ি। ঝালকাঠির মোল্লাবাড়ি ও ছত্রকান্দা গ্রামের ভেতর থেকে চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ও রাজাপুরের বাড়ইবাড়ি, পিংড়ি, হাইলাকাঠি, ইন্দ্রপাশা ও বাঘড়ী গ্রামের মধ্য দিয়ে বাকি আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রাজাপুর সদর খালের মোহনায় মিশেছে ধানসিঁড়ি। সেখান থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে জাঙ্গালিয়া নদী হয়ে আবার বিষখালী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে ধানসিঁড়ির প্রবাহ। আরও জানা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খাল কাটা কর্মসূচীর আওতায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নদীটির কিছু অংশ খনন করা হয়েছিল। এরপর আর তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সড়ক পথ তৈরির আগে ঝালকাঠি জেলা সদরের সঙ্গে রাজাপুর উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ধানসিঁড়ি নদী। অতীতে এই নদী দিয়ে এক্সপ্রেস সার্ভিসের স্টিমার খুলনা-কলকাতায় যাতায়াত করত। বড় বড় মালবাহী পালতোলা নৌকা এবং সাম্পানও চলাচল করত ধানসিঁড়ি নদীতে। দুই যুগ আগেও ধানসিঁড়ি নদীতে লঞ্চ ও কার্গো চলাচল করত। বর্তমানে রাজাপুর উপজেলার পাড়েরহাট এলাকা থেকে ভরাট হয়ে ধানের জমির সঙ্গে মিশে গেছে ধানসিঁড়ি নদীর বাকি অংশ। তলদেশে পলি জমে ভরাট ও দখলদারির ছোবলে ধীরে ধীরে ধানসিঁড়ি শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। এই খালে এখন নৌকা চলাচলও করতে পারে না। যেখানে পানি থাকে সেখানেও কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে খনন কাজের জন্য তিন বছর আগে ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই প্রকল্পে ধানসিঁড়ির পার পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। ধানসিঁড়ি পারের বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল গাজী বলেন, ‘আমাদের ছোট বেলায় এই নদীতে আমরা স্টিমার চলতে দেখেছি। এখন আর নৌকাও চলাচল করতে পারে না। তার পরেও যতটুকু আছে তা টিকিয়ে রাখতে জরুরী ভিত্তিতে খননের কোন বিকল্প নেই।’ স্থানীয় কৃষক কাশেম হাওলাদার বলেন, ‘ধানসিঁড়ি নদীর পানি দিয়েই হাজার হাজার কৃষক মাঠে ফসল ফলিয়েছে। এখন শীতকালে নদীতে পানি না থাকায় আমরা চাষাবাদ করতে পারছি না।’ রাজাপুর নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সৈয়দ হোসাইন আহমেদ কামাল বলেন, ধানসিঁড়ি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই নদীকে বাঁচাতে আমরা একাধিকবার মানববন্ধন ও প্রশাসন বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছি। জীবনানন্দ দাশ ও ধানসিঁড়ি নদী সম্পর্কে স্থানীয় সংবাদ কর্মীরা বলেন, ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোয় অসংখ্যবার সংবাদ প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। কখনও ইতিহাস নিয়ে, কখনও বর্তমান অবস্থা নিয়ে। নদীর আগের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে জরুরী ভিত্তিতে খনন প্রয়োজন। রাজাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উল্লাহ্ বাহাদুর বলেন, ধানসিঁড়ির দুই পারে শত শত হেক্টর উর্বর ফসলি জমি থাকলেও নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারছেন না। নদীটিতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে পারলে ধান ও রবি শস্যের ব্যাপক আবাদ সম্ভব হবে।
×