ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব

বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যে দু’জন নায়ক হয়ে উঠেছিলেন সে দু’জন হলেন এ. কে. ফজলুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের মানুষ তাদের ভালবেসে অভিহিত করে শেরে বাংলা ও বঙ্গবন্ধু নামে। কিন্তু আপামর সাধারণ মানুষ তাদের এক নামে চেনে হক সাহেব ও শেখ সাহেব। হক সাহেব বললে বাংলার মানুষ ফজলুল হক ছাড়া আর কাউকে চেনে না। শেখ সাহেব বললে একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কাউকে জানে না। বাংলাদেশে গণমানুষের রাজনীতিতে এই দু’নেতার অবদান অতুলনীয়। তেমনি ভাষা আন্দোলনেও। ভাষা আন্দোলনের প্রবীণ, নবীন অনেক শীর্ষ নেতা ছিলেন, যেমন প্রবীণদের মধ্যে মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম, আতাউর রহমান খান প্রমুখ এবং নবীনদের মধ্যে আবদুল মতীন, নইমুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, গাজিউল হক এবং আরও অনেকে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে এই আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে থেকেই হক সাহেব ও শেখ সাহেব, দু’জনে বয়সের ক্ষেত্রে নানা-নাতি হলেও বাংলা ভাষার ব্যাপারে কে ভূমিকা রেখে গেছেন, তা আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমে হক সাহেবের কথা বলি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (তখন বাংলা ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর স্টেটাস দেয়া হয়েছিল) হিসেবে হক সাহেব শিক্ষা মন্ত্রক নিজের হাতে রেখেছিলেন। তিনি শুধু প্রাইমারি শিক্ষাকে অবৈতনিক করেননি, সেকেন্ডারি লেভেল পর্যন্ত বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করেন। এ জন্য তৎকালীন ইংরেজ গবর্নর স্যার জন হার্বার্টের সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতে দেওবন্দ নিয়ন্ত্রিত ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার শিক্ষার মাধ্যম ছিল আরবি ও ফার্সি। শিক্ষণীয় বিষয় ছিল সেকেলে। বাংলা, বিজ্ঞান, ইংরেজী শিক্ষণীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এর সংস্কারে হাত দিলে মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্ষিপ্ত হবে এই আশঙ্কায় ওল্ড স্কিম মাদ্রাসার সংস্কারে হাত না দিয়ে ব্রিটিশ সরকার নিউ স্কিম মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে হক সাহেব নিউ স্কিম মাদ্রাসার পাঠ্য বিষয়ে বাংলা, ইংরেজী ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করেন এবং শিক্ষার মূল মাধ্যম করেন বাংলা। অবিভক্ত বাংলায় কোন মুসলিম ধর্মীয় কাজÑ যেমন মিলাদ অনুষ্ঠান, জুমার খুতবা পাঠ, বিয়েশাদি বা কোন সামাজিক কাজে বাংলা ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ফজলুল হক এসব ধর্মীয় কাজে বাংলা ব্যবহার প্রচলনের চেষ্টা করেন। তার উৎসাহে নজরুল আমপারার সুরার বাংলা কবিতায় অনুবাদ করেন এবং কবি গোলাম মোস্তফা, তখন হাওড়া গবর্মেন্ট স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, মিলাদের গোটা অনুষ্ঠানটির বাংলা তরজমা করেন। বাংলায় মিলাদ পাঠ শুরু হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরে (১৯৪৮) বাংলা ভাষার আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমর্থন জানান হক সাহেব। আন্দোলনের প্রথম বছরেই ঢাকায় স্কুল-কলেজে ধর্মঘট করার পর ছাত্র-জনতা রাজপথে যে শোভাযাত্রায় নামে তাতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। হক সাহেব ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য শোভাযাত্রায় যোগ দেন এবং পুলিশের লাঠি চার্জে হাঁটুতে আঘাত পান। তাঁর এই হাঁটুর ব্যথা কখনও সম্পূর্ণ সারেনি। মাঝে মাঝেই দেখা দিত। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন এবং হাঁটুর চিকিৎসার জন্য কলকাতা যান। সেখানে দেয়া তার বক্তৃতার অংশ বিশেষকে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার বিকৃত করে তাকে বরখাস্ত করার সুযোগ গ্রহণ করেন। আইয়ুব খান তখন ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জিওসি। তিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে প্রেসিডেন্ট হন এবং ‘ফ্রেন্ডস, নট মাস্টার্স’ নামে একটি স্মৃতিচারণামূলক বই লেখেন। এই বইয়ে হক সাহেবের চরিত্র হননের জন্য তিনি লেখেনÑ ১৯৪৮ সালে ভাষার দাবিতে ছাত্র মিছিল যখন প্রাদেশিক এসেম্বলি ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি এসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছিলেন এবং সব ঘটনা দেখেছেন। তিনি দেখেছেন ছাত্র মিছিলকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্য ফজলুল হক উস্কানি দিচ্ছেন। এটা ছিল আইয়ুবের ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার। ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে চীফ মিনিস্টার ইনওয়েটিং থাকাকালেই বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময় পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ঢাকায় তার সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসে ছিলেন না। ছিলেন করাচীতে। তিনি নির্বাচনে খালেক নেওয়াজ নামে এক ছাত্রনেতার কাছে পরাজিত হয়েছেন শুনে সারা প্রদেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ঢাকার ছাত্ররা মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউস দখল করে ফেলে। তারা দাবি করে বর্ধমান হাউসকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস করতে হবে। শুধু সলিমুল্লা হল, ঢাকা হল ও ফজলুল হক হল ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা মেটাতে পারছে না। একদল ছাত্র ঘোষণা করে, তারা বিছানাপত্র নিয়ে এসেছেন এবং বর্ধমান হাউসেই এখন থেকে থাকবেন। এই ঘটনায় ঢাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং খবরটা ভাবী মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের কানে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বর্ধমান হাউসে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) ছুটে আসেন। তিনি ছাত্রদের বলেন, তিনি তাদের জন্য নতুন ছাত্রাবাস তৈরি করবেন, কিন্তু বর্ধমান হাউসের জন্য তার অন্য পরিকল্পনা রয়েছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দু ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছে। তার পরিচালক হলেন বাবায়ে উর্দু আবদুল হক নামে উর্দুর এক প-িত। তার পাশাপাশি ঢাকায় তারা বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য কোন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেনি। বাংলার মানুষের দাবি তারা এড়িয়ে গেছে। এর পর হক সাহেব ঘোষণা দেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠা করা হবে বাংলা একাডেমি। এই একাডেমির প্রতিষ্ঠাই হবে তার সরকারের প্রথম কাজ। তিনি ছাত্রদের এই ভবন ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানান। ছাত্ররা বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি হবে শুনে বিনা বাক্যে ভবনটি ছেড়ে চলে যায়। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গবর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামানের কাছে শপথ গ্রহণের পর হক সাহেব শপথ নামায় বাংলায় সই করেন। চৌধুরী খলিকুজ্জামান মৃদু প্রতিবাদ জানান। বলেন, ‘হক সাহেব, বাংলাতো এখনও সরকারী ভাষার স্বীকৃতি পায়নি।’ হক সাহেব উত্তর দেন, বাঙালীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তাদের ভাষা ব্যবহৃত হবে সেজন্যে কি কারও স্বীকৃতির অপেক্ষা করার দরকার আছে? এরপর হক মন্ত্রিসভা বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেন। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে তিনি যে ভাষণ দেন তা ছিল সাহিত্য-রস মিশ্রিত অপূর্ব ভাষণ। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি হক সাহেব যখন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি একবার কার্জন হলে যে ভাষণ দেন তাতে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর জীবন্ত ইতিহাস। সেই বাংলা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে ভাগ হয়েছে। কিন্তু তার ভাষা ও সংস্কৃতি ভাগ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ভাগ হয়নি। এরাই আমাদের অভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তার প্রতিনিধি। এই জাতীয়তাকে ভিত্তি করেই বাঙালী একদিন বিশ্বে আবার আপন সত্তায় মাথা তুলে দাঁড়াবে।’ হক সাহেব পাকিস্তান সরকারের হাতে গৃহবন্দী হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শেখ সাহেবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা ভাষায় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারলে হয় তো পাকিস্তান সরকারের হাতে সকল লাঞ্ছনার ক্ষোভ ভুলতেন; শেখ সাহেবকে বলতেন, তুমিই আমার বিজয়ী উত্তরপুরুষ। এখন লিখব, ভাষা আন্দোলনের শেখ সাহেবের অনন্য ভূমিকার কথা। (শেষাংশ আগামী সপ্তাহে) লন্ডন, মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
×