ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু-কিশোরদের জন্য চাই বাঙালীর প্রাণের মেলা

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

শিশু-কিশোরদের জন্য চাই বাঙালীর প্রাণের মেলা

একটি অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা সুষ্ঠু শিশু-কিশোরদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ সাধনকল্পে প্রথমে পরিবার আর তারপর স্কুল-কলেজের ভূমিকা অনেকখানি। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তি রয়েছে সেগুলোর বিকাশ সাধন করাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন। আজকাল ‘মানি সেন্ট্রিক’ ব্যবস্থাপনায় কেবল লেনদেন হয় মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের কথা অনেক পরিবারই ভুলে গেছে। অথচ পরিবারের বন্ধন ও শিক্ষা পরবর্তী জীবনে মানস গঠনে সহায়তা করে থাকে। আর স্কুলগুলোতে যত না বই পড়ার চাপ তার চেয়েও অনেক বেশি এক ধরনের অসহায়ত্ব শিশু-কিশোরকে চাপাক্রান্ত করে থাকে। অথচ সম্প্রতি মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে অনুষ্ঠিত ‘বিজ্ঞান মেলা, বইমেলা, পাখিমেলা, চারু ও কারুমেলা, পুষ্পমেলা, পিঠামেলা, অলিম্পিয়াড ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী-২০১৯’ দেখতে গিয়ে মনে হলো এ ধরনের বাঙালীয়ানার বিকাশ সাধনের মেলা চারদিনের জন্য হয় সব স্কুলে তবে মুক্ত চিন্তার বিকাশ সাধন ও জাতি গঠনে সহজেই শেখ হাসিনার দিক দর্শক বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। শিশু-কিশোররা এদেশের ভবিষ্যত তাদের সঠিক পন্থায় বেড়ে ওঠার সময়ে মনের ভেতরে গেঁথে দিতে হবে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গদপী গরিয়সী।’ কেবল মুখস্থ করে পরীক্ষা দিলে তার সঙ্গে ফটোকপিয়ারের কোন পার্থক্য নেই। মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে গত ১২ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ খ্রিঃ পর্যন্ত একই মলাটে এতগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মেলার মাধ্যমে দেশ ও জাতির বিকাশ সাধনে কাজ করে চলেছে। মোঃ ফরহাদ হোসেন একজন দেশপ্রেমিক অধ্যক্ষ যিনি সামনে থেকে চল্লিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনে কাজ করে থাকেন। আসলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব অপরিসীম। জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেও বাঙালীয়ানার বিকাশ সাধন করতে হবে। আসলে মেলায় গিয়ে যেভাবে শিক্ষক শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করেছেন, তা তাদের মনোবিকাশে সহায়তা করছে। তাবুসাম নামের এক দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী বলল, ‘মুরগি আর কবুতর ফ্রিজ থেকে মা বের করে থাকেন। কিন্তু জ্যান্ত মুরগি আর কবুতর আগে দেখিনি।’ আসলে সময়ের বিবর্তনে শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করার যে কলাকৌশল তা রপ্ত করতে হলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য এ ধরনের মেলা যাতে প্রতিটি স্কুলে আয়োজন করা হয় তা যেন সবাই মনে রাখে। আসলে বর্তমান সরকার দশ বছরের অধিককাল আগে ক্ষমতায় আসার আগে, প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা অনেক ইংলিশ এবং বাংলা মিডিয়ামের স্কুলে পালন করা হয় না। মনে পড়ে আমি যখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে শিশু-কিশোরদের অঙ্কনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে এক সহকারী অধ্যাপক প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেছিলেন। অথচ তার বিরুদ্ধে সে সময়ে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আর সদস্যদের জানালেও কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কি দুর্ভাগ্য, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস টাঙ্গাইলে অবস্থিত হলেও অবৈধ প্রক্রিয়ায় কূটনৈতিকপাড়ায় আর বনানীতে পরিচালিত হচ্ছে। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনকারীরা তলে তলে সুশীল সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সতর্ক থাকতে হবে। মেলাসমূহের আয়োজন করেই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষান্ত হয়নি। আয়োজন করেছিল, দুটো শিক্ষামূলক সেমিনার ও কবিতা আর গানের উৎসব। সেমিনারদ্বয়ের বিষয়সমূহ ছিল, ‘শিল্পায়নে বাংলাদেশ : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ আর ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ ও আমাদের ভবিষ্যত বাংলাদেশ।’ দুটো সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সচেতন করা যাতে করে, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে আলো ছড়িয়ে দেয়। আসলে শিল্পায়ন করার জন্য বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার নির্বাচনে আসার আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বর্ণিত ১২৮ কোটি তরুণের কর্মসংস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন। আর বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উদ্যোক্তা ব্যবস্থাপনার ওপর পোস্ট ডক্টরেট করতে থাইল্যান্ডের নারিসুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই তখন দেখেছি ‘উদ্ভাবনী’ এবং ‘সৃজনশীলতা’র বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মাঝে জ্ঞানের বিকাশ করতে সচেষ্ট রয়েছে। আর আমাদের দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজে এখনও মুখস্থ বিদ্যাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। দুঃখ লাগে, বর্তমান সরকার দিয়েছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষানীতি-২০১০। অথচ শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমলাতন্ত্র। ২০১০-এর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা আইন ২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরু হলেও তা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী এবং শেখ হাসিনার নির্দেশনার বিপক্ষে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাথার ওপরে চড়ে বসার লক্ষ্য নিয়ে সাচিবিক কমিটি সকল নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন বাস্তবায়নে তৎপরতায় লিপ্ত। আমলাতন্ত্র যে কি জিনিস তা বোঝা যায়, দেশে সরকারী বেসরকারী ক্ষেত্রে শিল্পায়নের প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য ৩২টির মতো স্থানে যেতে হয়। অথচ চীনে কোন উদ্যোক্তা যদি উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা নিয়ে দরখাস্ত করে তবে ব্যাংকই তা ‘ঙহব ঝঃড়ঢ়’ সার্ভিসের আওতায় অনুমোদন দেয়। আবার কেউ ঋণ খেলাপী হয়ে তার ছবি বিলবোর্ডসহ সব জায়গায় জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে ঋণ খেলাপীকে সামাজিকভাবে ঘৃণার চোখে দেখা হয়ে থাকে। যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আজ উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে- আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছি। এর সিংহ ভাগ কৃতিত্বই হচ্ছে শেখ হাসিনার, অদম্য প্রাণ শক্তিতে ভরপুর শেখ হাসিনা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর স্বপ্নপূরণের দিশারী। নির্ভীকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে চলেছেন। তার কর্মের সীমানা সুদূরপ্রসারী। তার কারণেই আর্থিক মুক্তি ঘটেছে। যারা বাংলা অক্ষরকে ‘হিন্দু অক্ষর’ এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশনে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের দেশদ্রোহী বিবেচনা করে বিচার দাবি করছি। বইমেলায় মোঃ ফরহাদ হোসেনের ‘বাঙলা ও বাঙালীর উৎসব’ বইটি বেশ ভাল লাগল। এ উৎসবগুলো আমাদের প্রাণের উৎসব জীবন-জীবিকা ও মানুষের মধ্যে একটি অনবদ্য ঘটনা প্রবাহের সম্মিলিতভাবে ফুটে উঠেছে। এদিকে মোবাশ্বের আলী প্রণীত ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটিতে বাংলাদেশের হাজার বছরের অধিককাল ধরে দেশ, জাতি, মাটি ও শেকড়ে ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। মেলাতে কামাল আহমেদ মজুমদার প্রণীত ‘জীবন নদীর বাঁকে’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। শিল্প প্রতিমন্ত্রীর বইটির প্রকাশনায় যুক্ত হতে পেরে ভাল লাগল। মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রাণ ভ্রমরা কামাল মজুমদার বিদ্যালয়টির মান উন্নয়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিদ্যালয়টির আজ যে সম্প্রসারণ ঘটেছে, শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে- তা পেছনে থেকে তিনি সবসময়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্ক্রিল এনহেন্সমেন্টের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। এক্সসেস টু ইনফরমেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, আত্মনির্ভর, স্বকর্ম উদ্যোগী মানবসম্পদ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা করে বিদেশের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে ‘উদ্যোক্তা ক্লাব’ চালু করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকারপ্রধানের কাছে বিনীত নিবেদন এই যে, প্রতিবছর একদিন উদ্যোক্তা দিবস ঘোষণা করে, সে দিবসটি পালন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনকি বারাক ওবামার আমলে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোক্তা দিবস পালন করা শুরু হয়েছে। সবাই যদি চাকরি প্রার্থী হয় অথচ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায় তবে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে। এ জন্যই ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট এবং মাস্টার্স ইন ইকোনমিক্স (উদ্যোক্তা অর্থনীতি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনক্রমে চালু করেছে। ইতোমধ্যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্টের দুটো ব্যাচ সফলভাবে শিক্ষা কার্যক্রম সমাপ্ত করে সফলতার পরিচয় দিচ্ছে। আমার মনে হয় যারা স্কিল এনহেন্সমেন্ট বাস্তবায়নে জড়িত তাদেরকে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কাছে অনুরোধ থাকবে। ‘ঐঊঅঞ’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সকে অন্তর্ভুক্তকরণ করা। পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়ে যাতে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সে শেখ হাসিনার দেখানো পথে স্নাতক পর্যায়ে ব্যাচেলর অব ইকোনমিক্স (উদ্যোক্তা অর্থনীতি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনক্রমে চালু করা দেশের স্বার্থে প্রয়োজন। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ’ আদর্শ দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। নাসির নামের দশম শ্রেণীর এক ছাত্র বলেছিল ‘আমাদের এ সুন্দর দেশ ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি রয়েছে, অন্য স্কুলে থাকতে আগে জানতাম না।’ আসলে আজকের ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার চিন্তা চেতনাকে যদি শিশু-কিশোর বয়স থেকে ছড়িয়ে দেয়া যায় তবে ‘নর গড়তে গিয়ে বানর হওয়ার সম্ভাবনা’ থেকে মুক্ত থাকবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে স্বঅবস্থানে থেকে কাজ করতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোগ বিশেষজ্ঞ। [email protected]
×