ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালীর ভাষা আন্দোলন যুদ্ধ শুরুর ইতিহাস

(শেষাংশ) পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের যে ষড়যন্ত্রের শুরু তা পাকিস্তানের লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের দিনের একদিন আগেও শেষ হয়নি। সকল সময়ই নতুন নতুন আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে বাংলা ভাষা ও এ ভাষায় কথা বলা মানুষদের। পুরো ৫০ এর দশকব্যাপী বাংলা ভাষার আরবীকরণের প্রক্রিয়া জোরদার করা হতে থাকে। পাকিস্তানীদের এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালীদেরকে একটি অশিক্ষিত শ্রেণী হিসাবে রেখে তাদের শোষণ পাকাপোক্ত করা। কারণ, আরবী হরফ ছিল বাংলার মানুষের জন্য সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হরফ, যা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের জন্য নতুন করে শেখার বিষয়। এমনকি বাংলার শিক্ষিত সমাজের জন্যও বিষয়টি ছিল ততখানিই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ যতখানি কঠিন ও সময়সাপেক্ষ তা ছিল অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিতদের জন্য। পাকিস্তনীদের উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। তারা প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বাঙালীদের প্রতিযোগিতার বাইরে রেখে এ দেশে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে চাচ্ছিল। পাকিস্তানীরা কোনভাবেই বাঙালীদের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগির বিষয়টি চিন্তায় ঠাঁই দেয়নি। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার পরও এমন কি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হওয়ার পরও পাকিস্তানীদের এ ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি, বরং নতুন নতুন রূপে আরও শক্তিশালী হয়ে বাংলার ওপর আঘাত হেনেছে। তাই বাঙালীকে এক পর্যায়ে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়াতে হয়েছে বিদেশী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী শাসনের অবসান হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি সারা জীবনের অক্লান্ত শ্রম, মেধা ও ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালীর জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত ও সুসংহত করে জনতাকে দীক্ষিত করেছেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। নিজের জীবনের সকল কিছুর বিনিময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বাংলদেশকে; পৃথিবীর বুকে আজ তাই আমরা তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি শত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে। আমাদের বিজয়ের পথ ছিল ষড়যন্ত্রের বিষে পিচ্ছিল ও কন্টকময়। সেই ষড়যন্ত্র হত্যা করেছে জাতির জনককে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী নেতাদের, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দাদের চর-অনুচরের দল কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই আমাদের নেতৃত্বের ও নীতি নির্ধারকদের কাছাকাছি অবস্থান করে নেয় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের মতো আরেকটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পারিবার ও তাঁর সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন সহকর্মীদের, ঘটানো হয় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডগুলোকে: জেলখানায়, জনসভায়, সেনানিবাসে, এমনকি প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে। দীর্ঘ ২৬ বৎসর আমাদের জন্মভুমি পদদলিত হতে থাকে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারী ক্ষমতা দখলকারী ও তাদের দোসরদের দ্বারা। হত্যাকারীদের বিচার বন্ধ করে তাদেরকে বাংলাদেশের রক্তস্নাত পতাকাকে পদদলিত করার সুযোগ করে দেয় এ সকল পদলেহীর দল। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সুবাদে প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, ব্যবসা বাণিজ্যে, অর্থনীতির আনাচে-কানাচে সর্বত্র এখনও এদের অবাধ বিচরণ বিদ্যমান। সময়মতো এরা আবার আবির্ভূত হবে স্বমূর্তিতে। তাই আজ বড়ই প্রয়োজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ আঘাতে আঘাতে এদেরকে নিশ্চিহ্ন করার। ১৯৪৮ সালে মি: জিন্নাহর পূর্ববাংলা সফরের ফলশ্রুতিতে বাঙালীরা স্পষ্টতই বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানের অংশ হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের সমাজ, অর্থনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই। তারপরও বাঙালী সবকিছুর সমাধান চেয়েছে শান্তিপূর্ণতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। কিন্তু আমাদের সহনশীলতাকে বার বার পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকের দল দুর্বলতা বলে ভুল করেছে। সেই ভুলের মাসুল তাদের দিতে হয়েছে ’৭১ সালের লজ্জাজনক পরাজয়ের মাধ্যমে- নত মস্তকে বীর বাঙালীর দেশে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। জনতার শক্তির কাছে যুগে যুগে অন্য সকল শক্তি পরাভুত হয়েছে। বাংলার জাগ্রত জনতার প্রাণের দাবির কাছেও এক সময় পরাভূত হতে হলো পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের। বাংলা ভাষার দাবির প্রতি পাকিস্তানীদের অনমনীয় মনোভাবের ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশাল ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলো ঘটতে থাকে। পরিবর্তিত পটভূমিতে নতুন ষড়যন্ত্র ও বাঙালীর সংগ্রাম পাকিস্তানী শাসককুল তাদের চিরায়ত ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে পরিবর্তিত পটভূমিতে নতুন করে সাজাতে থাকে। তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার পরও পাকিস্তানী শাসকদের কা-জ্ঞানহীন কার্যকলাপ থেমে থাকল না। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর বাংলাবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড তীব্রতর হলো। আইয়ুব-মোনায়েম চক্র এক পরোয়ে ঢাকা বেতারে ও পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করল। রাষ্ট্রীয় সকল প্রকার অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জন করা হয়। মানুষের মধ্যে বিকৃত ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দুবিদ্বেষী প্রচারণা চালানো হতে থাকল অতি কৌশলে। এ সময়ই অনেক হিন্দু পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ভিটামাটি ছেড়ে ভারতে চলে গেল। তৃণমূল পর্যায়ের মুসলিম লীগ নেতারা হিন্দুদের জমিজমা দখল করতে লাগল। অপরদিকে দেশছাড়া হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত করার আইনী প্রক্রিয়া চলতে থাকল। বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্য সকলেই যে একই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই মূল্যবোধে মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য এ দেশের শিক্ষিত ও উদারপন্থী সমাজ তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলল। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র নেতৃত্বে থাকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে শ্রমিক লীগ, যেখানে ত্যাগী অনেক ছাত্র নেতা সর্বক্ষণিকভাবে শ্রমিকদের একতাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত। পুরো ষাটের দশকে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, অবদুল কুদ্দুস মাখন, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ছাত্র নেতাদের সংগ্রামী ভূমিকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি সীমাহীন আনুগত্য আমাদের জাতির স্বাধীনতার সকল সংগ্রামকে সফল করতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে অনেকেরই পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, স্বাধীনতার জন্য এঁদের অবদান চিরভাস্মর হয়ে থাকবে। অপরদিকে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই অনেকগুলো ব্যবস্থা নেয়া হয় যা ছিল বাংলা ভাষাকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করে যাওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সরকারী দলিলাদি, স্ট্যাম্প, পোস্ট কার্ড, যানবাহনের টিকেট, ব্যাংকনোট, ইত্যাদি প্রস্তুত করা হতে থাকে উর্দু ও ইংরেজী ভাষায়, যা অঞ্চলের অধিবাসীদের ব্যাবহারের অনুকূল ছিল না। এমন কি পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সিলেবাস থেকে আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত থাকা বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে দেয়! উপরন্তু, পিএসসি ১৯৪৭ সালের নবেম্বরের সিভিল সর্ভিস পরীক্ষার সিলেবাসে ৯টি ভাষার যে লিস্ট প্রস্তুত করে সেখান থেকেও বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়া হয়। এগুলো ছিল বাঙালীদের বিরুদ্ধে চরমতম উস্কানি। বাংলার মানুষের নিজের মাতৃভাষার অধিকার আদায় ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার এই সংগ্রাম ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে আরও অনেক বেশি সুসংহত হয়। আপাতদৃষ্টে এটিকে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন মনে করা হলেও এটি ছিল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন- যার পটভূমি রচিত হয়েছিল সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের পথ ধরেই। ইতিহাসের বহু পথ-পরিক্রম করে ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে, যেদিন ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ। সেই সঙ্গে লিখিত হয় বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়টি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আসে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের নিরঙ্কুশ বিজয়, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের ঘনঘটা। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামের স্রোতধারা বেগবান হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে থাকে শত্রুর সকল প্রতিরোধের দুর্গ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার আন্দোলন অবির্ভূত হয় বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিনিয়ে আনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে। পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান পরাভূত হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে দেশের মানুষ দেশ শাসনের অধিকার দেয়। পাকিস্তানীদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে তার বহু শতাব্দীর কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×