ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ছেঁড়া কাঁথার সড়ক ॥ মান নিয়ে মন্ত্রীর ক্ষোভ

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ছেঁড়া কাঁথার সড়ক ॥ মান নিয়ে মন্ত্রীর ক্ষোভ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীদের কাজ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের প্রকৌশলীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘রাস্তা নির্মাণ হলো, এক পশলা বৃষ্টি হলো, রাস্তা থাকে না। ছাল-বাকল সব উঠে যায়। তাহলে এই রাস্তা করার দরকার কি? রাস্তার জন্য বড় বড় বরাদ্দ। কিন্তু কিছু দিন গেলেই নানান সঙ্কট দেখা দেয়। কোথাও গর্ত, কোথাও দেবে যায়, ছেঁড়া কাঁথার রাস্তায় ফাটল দেখা যায়। এসব কেন হবে? মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সড়ক ভবনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় মন্ত্রী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সরকার এ ব্যাপারে কঠোর। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে ছাড় নেই। আগামী রোজার ঈদের আগেই সকল সড়ক চলাচলের উপযোগী রাখতে প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। সড়কের নির্মাণকাজের গুণগত মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে বলে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু সড়ক নির্মাণের তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সড়ক নির্মাণে গুণগতমান সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্প দলিল অনুযায়ী যথাযথ মান ও গুণের উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। মতবিনিময় সভায় সেতুমন্ত্রী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে নবনির্মিত সড়ক ভবনে দ্রুত সময়ে অধিদফতরের দাফতরিক কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে এ মুহূর্তে বেহাল সড়কের সংখ্যা অনেক কমে এলেও কিছু জেলা সড়কে সমস্যা আছে। এসব সড়ক বর্ষার আগেই যান চলাচলের উপযোগী করতে হবে। প্রয়োজনে রাতেও কাজ করতে হবে। আগামী মার্চের প্রথমার্ধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নবনির্মিত দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু চালু হতে যাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, জনগণের ঘরেফেরা স্বস্তিদায়ক করতে ঈদ-উল-ফিতরের আগেই দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ঈদের আগেই চালু হতে যাচ্ছে এ মহাসড়কে নবনির্মিত কোনাবাড়ি, চন্দ্রা ফ্লাইওভারসহ দুটি রেলওয়ে ওভারপাস এবং চারটি আন্ডারপাস। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এ দুটি মহাসড়কের দুপাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা দুটি লেন নির্মাণ করা হবে। কক্সবাজারে পর্যটকদের বিনোদন সুবিধা বাড়ানো জরুরী মন্তব্য করে ওবায়দুল কাদের সড়কপাশে আলোকসজ্জাসহ মেরিন ড্রাইভের কলাতলী প্রান্তে ক্ষতিগ্রস্ত দুই কিলোমিটার সড়ক ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেন। সম্প্রতি একনেকে পাস হওয়া লিংক রোড থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ দ্রুত শুরুর উদ্যোগ নিতেও তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। মতবিনিময় সভায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের পরিচালক সানাউল হক, সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-১-এর পরিচালক মোঃ ইসহাক এবং প্রকল্প-২-এর পরিচালক শাহরিয়ার আলম, ক্রস বর্ডার প্রকল্পের পরিচালক মোঃ আতিক, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মঈনুল ইসলামসহ ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী সড়ক জোন, সার্কেল এবং ডিভিশনের প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বলেন, রমজানের ঈদের আগেই সব ধরনের ভাঙ্গা রাস্তা মেরামত করতে হবে। চলতি কাজ শেষ করতে হবে। মানুষ যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন, রাস্তা ইউজেবল (চলাচলে উপযোগী) করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সড়ক ও জনপদ বিভাগকে নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের এখানে ওভারওয়েট একটা প্রবলেম, সেটা সবাই জানি। তাই বলে এত দ্রুত কেন রাস্তার বেহাল দশা হবে? মন্ত্রী বলেন, ‘আমার নিজের জেলার বেগমগঞ্জেও একটা সড়কের কাজে ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছিল। অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তেও সেটা প্রমাণ হয়। মন্ত্রীর নিজের এলাকাতেও যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে অন্য এলাকায় কী হতে পারে? তিনি বলেন, আপনাদের প্রতি আমার প্রধান নির্দেশনা হচ্ছে, ‘রাস্তার কাজের মান যেন নিশ্চিত করা হয়। কাজটা যেন ৩, ৪ বা ৬ মাসে নষ্ট না হয়ে যায়। কাজটা দেশের কাজ। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। অনেক সময় প্রয়োজনে রাতেও কাজ করতে হবে। অনেকেও করেন, অনেকে করেন না। সরেজমিন দেখেছি। অনেক ত্রুটি ও দুর্বলতার ছবি দেখতে পাই। অবশ্য অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছেন সততার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিশ্রুতিশীলতার সঙ্গে কাজটা করেন। আবার অনেক ইঞ্জিনিয়ার দেশের কাজ হিসেবে নয় চাকরি মনে করেই করেন। আখাউড়া সড়কের কাজের অগ্রগতি নেই। এই এলাকায় মানুষের জনদুর্ভোগ চরমে। সামনে বর্ষা। কী যে হবে। আইনমন্ত্রী ও মতিন খসরু এখন প্রতিদিন আমাকে ফোন করবেন, উল্লেখ করে রাস্তাটি দ্রুত শেষ করার আগে অন্তত ব্যবহার উপযোগী করার নির্দেশ দেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, কাজের কোয়ালিটি খারাপ হলে দায় নিতেই হবে। কারণ আজকাল কিন্তু ফেসবুকে লোকজন রাস্তার ছবি তোলেন। ভোগান্তির ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেন। কোন কিছু আর হাইড করা যায় না। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের কারণে মুহূর্তেই ভোগান্তির তথ্য প্রচার পায়। সুতরাং অনিয়ম দুর্নীতির ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। কাজের ব্যাপারে মনোযোগী থাকা দরকার আপনাদের। ওবায়দুল কাদের বলেন, আমার মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়ায় রিপোর্ট আসে। এটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। মন্ত্রণালয়ের কোন কাজের অনিয়ম-দুর্নীতি হলে মন্ত্রী হিসেবে কি আমি দায় এড়াতে পারব? ফর নাথিং আমি এ দায়টা কেন নেব? আমি তো নিজে আপনাদের কাছ থেকে কাজের জন্য পার্সেন্টেজ নিই না, কমিশন খাই না। প্রমোশন দিয়ে টাকা নিচ্ছি না। কাউকে বদলি করে টাকা খাওয়া, সেটাও এখন তো বন্ধ। এক সময় তো চিফ ইঞ্জিনিয়ার হতেও টাকা লাগত। প্রমোটেড হতেও টাকা লাগত। সেটাও তো নেই না। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়। কেন দায় বহন করতে হবে? এসব ছবির পরিবর্তন হলে অন্য যেসব সমালোচনা আছে তা একটু চেষ্টাতেই আমরা অতিক্রম করতে পারব। তিনি বলেন, আগে তো অনেক তদবির হতো। প্রথম মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম ৩-৪ বছর রুলিং পার্টির তদবিরের জ্বালায় থাকা ছিল দায়। এখন সেটাও নেই। এখন সাহসও পায় না। কারণ এখন তদবিরে কাজ হয় না,- বলেন তিনি। বেঁচে থাকতে কত টাকা লাগে? টাকা দিয়ে কী করবেন? সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের কাছে এভাবেই জানতে চাইলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, কোথাও কোথাও তিন মাসে রাস্তা নষ্ট, বেঁচে থাকতে কত টাকা লাগে? টাকা দিয়ে কী করবেন? মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে চিঠি আসলে, সেটা কী আমাদের জন্য ভাল খবর? ‘যারা সৎ, তারাও তো এতে কষ্ট পান। তারা কেন অল্প কয়জনের অপকর্মের জন্য দায় নেবেন! যারা ভাল ও সৎ তারাই এখন থেকে অসৎদের ঠেকাবেন। তিনি বলেন, আমি কাজের মানুষ চিনি। ভালদেরও চিনি। সবাই খারাপ হলে রাস্তা হয় কিভাবে! আমি বুঝি না, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে এক বছরেই কিভাবে নষ্ট হলো! ওভারলোডিং আছে বুঝলাম। কিন্তু এটাই কী মূলকারণ! আমরা জানি ওই সড়কের কয়েকটা স্থানে সয়েল কন্ডিশন অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা তা দেখলেন না! তারা কী করলেন?’ তিনি বলেন, ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে নির্মাণ ব্যয় বেশি হচ্ছে। কিন্তু কাজ তো ভাল হচ্ছে। টাকা বেশি লাগলে আমি রাজি আছি। কিন্তু কাজ ভাল হতে হবে। সওজের হারানো সুনাম ফিরিয়ে আনতে হবে।
×