ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরও বাড়ল ডলারের দাম

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আরও বাড়ল ডলারের দাম

রহিম শেখ ॥ আমদানি ব্যয় বাড়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে টাকা। বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া ঋণ এবং পণ্য আমদানির দায় পরিশোধের চাপে এ অবস্থা। যদিও ডলারের দাম বাড়লে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। অন্যদিকে রফতানিকারক ও রেমিটেন্স গ্রহীতারা সুবিধা পান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সোমবার বাংলাদেশে প্রতি এক ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ১২ পয়সা। এক বছর আগে এক ডলার কিনতে ব্যয় হতো ৮২ টাকা ৯২ পয়সা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এ সময় পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ১৫৫ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে ২৩১ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রির পরও গত সোমবার প্রতি ডলারে ১২ পয়সা বেড়েছে। এর আগে গত ২ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডলার ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে না। মঙ্গলবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১৫৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই দিনে যেখানে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ডলার। ২০১৭ সালের জুনে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৩শ’ কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়েছিল। ওই বছরের জুন শেষে রিজার্ভ ছিল তিন হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রফতানি ও রেমিটেন্সের তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় এমনিতেই বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চাপ থাকে। এবারে আমদানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও আগের অর্থবছরের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির ওপর যে হারে বাড়ছে, তার চাপ রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে শুধু বেসরকারী খাতে ১১শ’ কোটি ডলারের বেশি ঋণ রয়েছে। সুদসহ এসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর বেড়েছে। এরপরও বাংলাদেশে ডলারের দর যে হারে বেড়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকায় বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে আমদানিতে তিন হাজার ৭ কোটি ডলারের ব্যয় হয়েছে। বর্তমানের এ আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর আমদানি বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত রফতানি আয় হয়েছে ২ হাজার ৫০ কোটি ডলার এবং রেমিটেন্স এসেছে ৭৪৯ কোটি ডলারের। রফতানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। রেমিটেন্স বেড়েছে ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। জানা গেছে, ব্যাংকগুলো আমদানিতে ডলারের দর যাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরের কাছাকাছি রাখে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ রয়েছে। যদিও কিছু ব্যাংক বিক্রি করছে তার চেয়ে বেশি দামে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন করে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির তথ্য পাওয়ায় দুদফায় ৩৪টি ব্যাংককে শোকজ করে। এরপরও কিছু ব্যাংক এখনও ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারী একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা বাজার অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। অথচ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময় সময় টেলিফোন করে দর বেঁধে দিচ্ছে। দাম বেঁধে দিয়ে একতরফা বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে সেভাবে ডলার দিয়ে সহায়তা করছে না। যেসব ডলার বিক্রি করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই পাচ্ছে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক। আবার রফতানিকারকরা বেশি দাম পেতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে ব্যাংকে এলসি খুলছে, ডলার ভাঙাতে চাইছে আরেক ব্যাংকে গিয়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো অনেক সময় ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সরঞ্জামের আমদানি বেড়েছে। আমদানি খরচ মেটাতে ডলারের চাহিদাও বেড়েছে, ফলে ‘স্বাভাবিক কারণেই’ বাড়ছে ডলারের বিনিময় হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ব্যয় যেখানে ২৯ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে রফতানি আয় ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং রেমিটেন্স ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও আগে কমানো দরকার ছিল বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত ছিল। ভারত, ভিয়েতনামসহ বাংলাদেশের প্রতিযোগী বিভিন্ন দেশ আগেই তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। আমরা অনেক দেরিতে এই কাজটি করছি। তবে টাকা যেন খুব বেশি দুর্বল হয়ে না যায়- সে বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ধারণা, আমদানি বাড়ার পাশাপাশি ‘প্রচুর অর্থ’ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে; রফতানি আয় তার চেয়ে অনেক কম হারে বাড়ছে। রেমিটেন্স প্রবাহের গতিও খুব বেশি নয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দর বাড়ছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়টি হলো, বিরাট একটা অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আহসান মনসুর বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে মূলত তিন ভাগে। প্রবাসীরাদের মাধ্যমে যে রেমিটেন্স দেশে আসার কথা সেটা না এসে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তা কানাডা-আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। যে রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা, তা দেশে না এসে বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি পথ হচ্ছে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস দেখানো। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য আনা অথবা খালি কন্টেনার আনার ঘটনাও ধরা পড়েছে কখনও কখনও। আবার পণ্য রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়। যে পণ্যের দাম ১০০ ডলার, ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তা ৭০ ডলার দেখিয়ে রফতানি করেন ব্যবসায়ী। বাকি ৩০ ডলার তিনি বিদেশে সেই ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে তা বিদেশেই রেখে দেন।
×