ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

বড় মনের বরেণ্য ফুটবলার টিপু

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বড় মনের বরেণ্য ফুটবলার টিপু

ফুটবলের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করেই পাড়া মহল্লা আর স্কুল মাতিয়েছেন। তাঁর গানের গলায় মুগ্ধ হয়েছিলেন ওস্তাদ গাফফার খান। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে সংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করুক। নামকরা গায়ক আর অভিনয় শিল্পী হবে। কিন্তু ফুটবলের প্রতি আগ্রহ সব কিছুকেই পিছনে ফেলে দেয়। সেই ওস্তাদ গাফফার খানের ইচ্ছাতেই গান বাদ দিয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। বাবা আর তাতে বাধা দেননি। অবশেষে ১৯৬৪ সালে বিজি প্রেস দলের জার্সি গায়ে জড়িয়ে স্বপ্নপূরণের যাত্রায় প্রথম ধাপে পা রাখেন। তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের সেরাদের সেরা লেফট উইংগার এসএম গোলাম সারোয়ার মোস্তফা টিপু। সমর্থকদের কাছে যিনি টিপু নামেই পরিচিত। টিপুর জন্ম বরিশাল জেলায়। ছোটবেলায় নাটক আর গান বাজনার সঙ্গে সখ্যতা হলেও ফুটবল যেন তাকে মাঠে টানতো। ফুটবলের প্রতি তার মোহ এবং এক সময়ের কৃতী ফুটবলার চুন্না রশিদ ও সোনা মিয়া তাকে বড় ফুটবলার হতে সাহায্য করেছেন। তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে তার ফুটবলের যাত্রা শুরু। ১৯৬৩ সালে জুনিয়র লিগে তিনি এই ক্লাবের পক্ষে অংশ গ্রহণ করেন। তখন তার পজিশন ছিল রাইট ফুল ব্যাক কিন্তু সোনা মিয়া তার খেলা দেখে আঁচ করেছিলেন টিপু উইং পজিশনে ভাল খেলবেন। তাই তাকে উইংগার হিসেবে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে লেফট উইং পজিশনেই টিপু হয়ে উঠেন দুর্ধর্ষ। টিপু নিজে খেলতেন আর খেলাতেন দলকে। ফুটবল সম্পর্কে তার ধারণা ছিল স্বচ্ছ ও সাবলীল। টাচ লাইন দিয়ে দ্রুত গতিতে বল নিয়ে ছুটে প্রতিপক্ষের দুতিন জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে নিখুঁতভাবে ডি বক্সে থ্রুু ঠেলে দেওয়া ছিল দেখার মতো। মূলত ১৯৬৪ সালে প্রথম বিভাগ বিজিপ্রেস দলের জার্সি পরেই ফুটবলে যাত্রা শুরু। পরের বছরেই যোগ দেন ওয়ারীতে। ওয়ারীতে যোগ দেওয়ার ঘটনার তিক্ত অভিজ্ঞতা আজও তাঁর মনে পড়ে। আলোচনায় জানা যায় সেই সময় ওয়ারীর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশেম। ওয়ারীতে যিনি লেফট উইং পজিশনে খেলতেন তার বয়স হয়ে গেছে বিধায় সে পজিশনে নতুন মুখ খোজা হচ্ছে। হাশেম সাহেবের প্রথম পছন্দ তরুণ টিপুকে। তিনি টিপুকে সে বছর আগাখান টুর্নামেন্ট খেলার আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রেক্ষিতে ক্লাবে আসতে বলেন। তখন আজাদ, ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডার্স সব মতিঝিলে এক সারিতে। ১৯৭৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার পাওয়া টিপু ক্লাবে গিয়ে দেখেন সব সিনিয়র খেলোয়াড়রা এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। তিনিও খাবারে অংশগ্রহণ করেন। কিশোর টিপুকে দেখে সিনিয়র খেলোয়াড়রা টিপ্পনী কাটতে থাকেন, ‘এই পোলা কি খেলবো? নাক টিপ দিলে দুধ বাইর হইবো।’! এই ধরনের কথাবার্তা টিপুকে খুব বিব্রতকার অবস্থায় ফেলে দেয়। খাবার টেবিলে তাঁকে নিয়ে ওয়ারীর সিনিয়র খেলোয়াড়দের টিপ্পনি কিংবা বাজে মন্তব্য ওই মুহুর্তে খারাপ লেগেছিলো বটে কিন্তু তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহন করেছিলেন বিষয়টা। কেননা যখন কেউ দেখে তাঁর জায়গা চলে যাচ্ছে তখন নতুন কাউকে সহ্য হওয়ার কথা নয়, টিপু সব বুঝে মনের মধ্যে জিদকে পুষে রেখেছিলেন। যা পরে তার খেলা দিয়ে কড়ায় গ-ায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি একজন জাত খেলোয়াড়। অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন খেলার মাঠে এবং বাইরে। মাঠে যা ভুল হতো খেলার পর একাকী তা অনুশীলন করে শুধরাবার চেষ্টা করতেন। খেলার মাঠে মাঝে মধ্যে মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন, তাই অনেকেই তাকে মেজাজি খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে মাঠের বাইরে তিনি মানুষ হিসেবে চমৎকার। ওয়ারী থেকে রহমতগঞ্জ থেকে ভিক্টোরিয়া হয়ে ১৯৬৮ সালে যোগ দেন তারই প্রিয় দল সাদাকালো ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে প্রিয় মোহামেডানে যোগ দেয়ার ক্ষণটাও টিপুর মনে আজও উজ্জ্বল। ফুটবলার গজনবী খেলা ছেড়েই মোহামেডানের অফিসিয়াল হিসেবে যোগ দেন । তার ছিল তীক্ষè দৃষ্টি। কারও খেলা নজরে পড়লে রেহায় নেই। যেকোন উপায়েই তাকে মোহামেডানে আনা চাই। গোলাম সরোয়ার টিপুর খেলা মনে ধরে গজনবীর। তিনি দায়িত্ব দেন টিপুর বাসার পাশে থাকা আরেক খেলোয়াড় জহিরুলকে। জহিরুল তার ভ্যাসপায় টিপুকে উঠিয়ে সোজা মোহামেডান ক্লাবে একেবারে গজনবীর সামনে। একে তো গজনবীর কথা আবার তারই প্রিয় ক্লাব মোহামেডান। যেন সোনায় সোহাগা। মোহামেডানে তখন প্রতাপ সংকর হাজরা, মুসা, মারিসহ সব নামকরা খেলোয়াড়। তবুও বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন টিপু। বাবা শুনে ছেলেকে চ্যালেঞ্জ নিয়েই খেলতে বললেন। আরও বলেন জীবনে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ নিয়েই সামনে এগুতে হবে। বাবার এই কথায় টিপু মোহামেডানে খেলা নিয়ে আর সংশয় রইল না। মোহামেডানের হয়ে টিপুর প্রথম ম্যাচ রহমতগঞ্জের সঙ্গে। মুসা তিন ম্যাচ সাসপেন্ডের কারণে অভিষেক হয় টিপুর। প্রথম ম্যাচেই রহমতগঞ্জের সঙ্গে হেরে যায় মোহামেডান। সব দোষ ঘাড়ে চাপে টিপুর। টিপুর মন ভেঙ্গে যায়। খেলার সব সরঞ্জামাদি সোহবানবাগের এক ডোবায় ফেলে দেন। পরের দিন জহিরুলের ডাকে আবারও ক্লাব টেন্টে যান টিপু। দ্বিতীয় ম্যাচে এক গোল পাণ টিপু। জয় পায় মোহামেডান। তৃতীয় ম্যাচে টিপুর কারিশমায় ওয়ারীর সঙ্গে ৩-০ গোলে জয়লাভ করে মোহামেডান। চতুর্থ ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে মাঠে ফিরে আসেন মুসা। ওই ম্যাচে আর যায়গা হয়নি টিপুর। মোহামেডান পিডব্লিউডি এর সঙ্গে হেরে যায় ২-০ গোলে। পরের ম্যাচে মুসা এবং টিপু একসঙ্গে মাঠে নামেন। মুসা চলে যান সেন্টার ফরোয়ার্ডে এবং টিপু খেলেন তার পজিশন লেফট উইং এ। গোলাম সরোয়ার টিপু অনেক গুণে গুণান্বিত। তিনি ভাল গান গাইতে পারেন। ছোটবেলায় নাটক করেছেন। আবৃতি করতেন নিয়মিত। বোনদের সঙ্গে নাচও শিখেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো তিনি আকাশ আর মাটি নামের একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। স্বাধীনতার পরপর আসামের বরদুলাই ট্রফিতে খেলতে যান টিপু। সে সফরে গান গেয়েছিলেন এ কে এম নওশেরুজ্জমান এবং টিপু। কোন অনুষ্ঠানে গেলে হুট করে আবাহনীর আশরাফ ঘোষণা দিয়ে বসতেন এবার গান গাইবেন টিপু ও নওশের। টিপুর মনে জমানো অনেক মজার স্মৃতি আছে। একবার গুলিস্তান হলে ইংরেজী ছবি দেখতে যান ওয়ারীর গোলরক্ষক তপনকে নিয়ে। লাইট ম্যান এসেই চিনে ফেলেন ফুটবলার টিপুকে। তিনি তার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে যান। পরে ফিরে এসে টিকিটের দাম ফেরত দিয়ে যান। এ ঘটনাটা টিপুকে সেই জমজমাট ফুটবলের স্বর্ণালী দিনকে মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান ফুটবলের অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান বাংলাদেশ ফুটবলের এই হাল দেখে খুব খারাপ লাগে। নিজেকে ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন। টিপু জানান মোহামেডান আবাহনী দুই শীর্ষ ক্লাবেই খেলেছেন। কিন্তু সমর্থকরা সবাই আমাকে মোহামেডানের টিপু বলতেন। আমিও খুব প্রাউড ফিল করতাম। আজ মোহামেডানের অবস্থা দেখলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। স্মরণীয় মুহূর্তের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে টিপু জানান স্বাধীনতার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ফুটবল ম্যাচ হয় বাহাত্তরের মার্চ মাসে। সেটা ছিল রাষ্ট্রপতি একাদশ এবং মুজিব নগর একাদশের মধ্যে। রাষ্ট্রপতি একাদশে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং মুজিব নগর একাদশে ছিলেন তার বাইরের খেলোয়াড়রা। টিপু খেলেন রাষ্ট্রপতি একাশের পক্ষে। তার দল ২-০ গোলে জয়লাভ করে। টিপুর ছিল সেই ম্যাচে প্রথম গোল। তাই তিনি মনে করেন স্বাধীনতার পর ঢাকা মাঠে প্রথম গোলদাতা হিসেবে তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে আছে। তাছাড়া আরও একটি দিকে টিপু প্রথম এর সাক্ষী হয়ে আছেন। ১৯৬৮ সালে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে অবতীর্ণ হয় ঢাকা মোহামেডান বনাম শ্রীলঙ্কা। সে ম্যাচে মোহামেডান ৫-১ গোলে জয়লাভ করে তৃতীয় বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে। টিপু করেন দুই গোল। প্রথম বারের মতো টেলিভিশন সে ম্যাচটি লাইভ টেলিকাস্ট করে। নবীন খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে তিনি জানান আজকাল খেলোয়াড়রা অর্থ পাচ্ছে সেটা নিঃসন্দেহে ভাল সংবাদ কিন্তু ক্লাবকে তার প্রতিদান দিতে হবে। মনে হিংসা থাকবে সেটা খেলার। অনুশীলন অনুশীলন এবং অনুশীলন। প্রতি ম্যাচ খেলার পর নিজের ভুলগুলো নিজেকেই শুধরিয়ে নিতে হবে। অতিরিক্ত অনুশীলন করতে হবে যেন আগের ম্যাচের ভুল পরের ম্যাচে না হয়। ১৯৬৮-১৯৭০ তিন বছর খেলেন মোহামেডানে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পর নতুন আবির্ভাব হওয়া আবাহনী ক্লাবে যোগ দেন টিপু। আবাহনীতে ১৯৭২-১৯৭৪ পর্যন্ত খেলেন। আবার ১৯৭৫ সালে সালে ফিরে আসেন মোহামেডানে। সেখানে ১৯৭৯ পর্যন্ত খেলেন। পায়ের চোটের কারণে টিপুর খেলার গতি কমে যেতে বসেছে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্ব^র মাসে সফরকারী কলকাতা মোহামেডান এবং ঢাকা মোহামেডানের মধ্যে ম্যাচে টিপুর চমৎকার থ্রু থেকে আসলামের গোলে এগিয়ে যায় ঢাকা মোহামেডান। ঠিক সেই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় রাখার জন্য টিপু ফুটবল মাঠের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। খেলোয়াড় হিসেবে মাঠ ছাড়লেও পরবর্তীতে কোচ হিসেবে দেখা যায় গোলাম সারোয়ার মোস্তফা টিপুকে। ১৯৮০ সালে মোহামেডানের কোচ হিসেবে অভিষেক হয়। খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে বহুবার দেশের বাইরে সফর করেছেন। ফুটবল যেন তার নেশা। গোলাম সারোয়ার মোস্তফা টিপু সম্পর্কে বলতে গিয়ে মোহামেডানের একনিষ্ঠ সমর্থক টিক্কু জামান জানান, টিপু ভাই হলেন ফুটবল বিশ্লেষক, নিজের উপলব্ধিকে অন্যের মাঝে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। ফুটবল মেধা, স্কিল এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তার অনেক বেশি। এ কারণে তিনি অন্যদের চাইতে আলাদা। দেশের ফুটবলে অনেক সেরা খেলোয়াড়দের আবির্ভাব হয়েছে। মাঠ মাতিয়েছেন অনেকেই কিন্তু সমর্থকদের মনে ক’জন জায়গা করে নিতে পেরেছেন? দেশে যদি কখনও সেরা ফুটবলারদের তালিকা করা হয় তবে অবশ্যই তালিকায় আসবে একটি নাম, সেটা বড় মনের মেজাজী খেলোয়াড় গোলাম সারোয়ার টিপু।
×