পাঁচ বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে মোদির বিজেপির হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিল কংগ্রেস। ৫৪৫টি আসনের মধ্যে দলটি মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল। এত শোচনীয় পরাজয় কংগ্রেসের ইতিহাসে আর হয়নি। তার জন্য বিধান সভার নির্বাচনে কংগ্রেসের হাল হয়েছিল আরও শোচনীয়। ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত ভূখ-ের মধ্যে মাত্র ৩টি হয়েছিল কংগ্রেস সরকার। এমনও বলাবলি হচ্ছিল যে মোদি ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করে ছাড়বে।
কিন্তু বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে ১৩৩ বছরের পুরনো দলটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হারানো ছন্দ ফিরে পেয়ে যেন নতুন প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে দলটি। গত ডিসেম্বরে দলীয় ক্যাডারদের বিস্মিত করে দিয়ে কংগ্রেস হিন্দী ভাষীদের প্রাণকেন্দ্র এবং দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই পরিচয় পাওয়া গেছে। যেমন ধ্বংসের কিনারায় গিয়ে আবার দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, মোদির ওপর থেকে জনগণের মোহমুক্তি ঘটে যাওয়া এবং বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির বাড়াবাড়িতে জনমনে বিরক্তি ও বিরাগ সৃষ্টি হওয়া। একদিকে কংগ্রেস দলটি যেমন লক্ষণীয় রকমের বলীয়ান হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে বিজেপির ইমেজ তত ম্লান হচ্ছে। সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সেদিন পর্যন্ত মোদির কণ্ঠ প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। কংগ্রেস সভাপতি রাহুলকে অপরিণত রাজনীতিক হিসেবে চিত্রিত করা হতো। এখন অবস্থা বদলাচ্ছে। মোদি এখন আর সমালোচনার উর্ধে নন। রাহুলকেও আর সেভাবে দেখা হচ্ছে না।
ভারতে জনমত জরিপ অতিমাত্রায় অনির্ভরযোগ্য হলেও গত এক বছর ধরে যে ধারা বা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা পরিষ্কার। সামনের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যতগুলো আসনে বিজয়ী হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে তার সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। দলটি সম্ভবত তার বর্তমান নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারবে না। অন্যদিকে কংগ্রেস সম্পর্কে জরিপের পূর্বাভাস হচ্ছে দলটি তার বর্তমান আসন সংখ্যার তিন গুণ বেশি আসন পাবে। তারপরও তা ২শ’ আসনের কম হবে এবং বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে থাকবে। তবে কংগ্রেসের ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলোকে জোটবন্ধ করে বৃহত্তর কোয়ালিশন গঠন করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ভিন্নমতের মিত্ররা যে দলটিকে ঘিরে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তেমন একটি দলের বৈশিষ্ট্য কংগ্রেসের অনেক বেশি আছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভোটাররা কাকে দেখতে চায় সেই ধারণার ক্ষেত্রেও গত দু’বছরের জনমত সমীক্ষায় পরিবর্তন এসেছে। দেখা গেছে এ ব্যাপারে রাহুল গান্ধীর তুলনায় মোদি বেশ জোরেসোরে এগিয়ে ছিলেন। মোদির ছিল ৪৩ শতাংশ পয়েন্ট। সেই পয়েন্ট এখন ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। রাহুল সম্প্রতি তার বোন প্রিয়াঙ্কাকে দেশের সর্বাধিক জনবহুল ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে নিজের অনুকূলে আরও কিছুটা গতিবেগ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। প্রিয়াঙ্কা বেশি ভোট টেনে আনতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে তার তারকা ইমেজ মোদির ওপর অন্যদের দৃষ্টির অনেকখানি নিঃসন্দেহে কেড়ে নিতে পারবে। মোদি গত পাঁচটি বছর মিডিয়ায় অকুণ্ঠ ও সপ্রশংস কভারেজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এখন অন্য একজন এসে তাতে ভাগ বসাবে।
তবে নেহরু পরিবারের গ্ল্যামার এবং কংগ্রেসের নতুন গো-বান্ধব নীতির কারণেই সে দলটির নির্বাচনী সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়েছে তা নয়। রাহুল ইতোমধ্যে একজন উদ্যমী ম্যানেজার হিসেবে নিজের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। কৌশলগতভাবেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কিছু কিছু দায়িত্ব তিনি অন্যদের হাতে বিচক্ষণতার সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছেন এবং স্থানীয় পর্যায়ের ছোট খাটো বিষয়গুলো দেখাশোনা করা থেকে বিরত থেকেছেন। কংগ্রেসের নতুন গতিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো দলটি কাম্য নেতাদের বক্তব্য ও সিদ্ধান্তের প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে। এই ধারাটি বিজেপির ধারার বিপরীত। কারণ মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিতে ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ লক্ষণীয়।
মোদি সরকার গত ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট ঘোষণার মাত্র কদিন আগে রাহুল গান্ধী তাঁর সাহসী নির্বাচনী প্রচারে এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন যে ক্ষমতায় গেলে তারা সকল ভারতীয়ের জন্য ন্যূনতম নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করবেন। এতে কৃষক, করদাতা ও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ খুশি হয়েছে। অন্যদিকে বেকারত্বের ভয়াবহ তথ্য পরিসংখ্যান ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে মোদি সরকার এমন অভিযোগ উঠেছে। তবে এটা ঠিক যে খুব কমসংখ্যক ভারতীয়ই রাহুল গান্ধী অথবা নরেন্দ্র মোদির প্রদত্ত প্রতিশ্রুর্তি ওপর আস্থা রাখে।
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: