ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি থেকে ঢালাও পদত্যাগ এখন সময়ের বিষয় মাত্র - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিএনপি থেকে ঢালাও পদত্যাগ এখন সময়ের বিষয় মাত্র - স্বদেশ রায়

দেশের একজন বড় ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা আলী আসগর লবি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করার পরে দেশের মিডিয়ায় খুব একটা হৈচৈ হয়নি, যত না হৈচৈ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান কৌঁসুলি ব্যারিস্টার রাজ্জাকের জামায়াত থেকে পদত্যাগ নিয়ে। বলা হতে পারে, রাজ্জাক জামায়াত নেতাদের ১৯৭১ এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছে এ জন্য বিষয়টি নিয়ে বেশি হৈচৈই হচ্ছে। কিছু জামায়াতপ্রেমিক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এখনও জামায়াতকে টিকিয়ে রাখতে তাদের ক্ষমা চাওয়ানোর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জাতি এখন আর জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার অপেক্ষায় বসে নেই। জাতি জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রকাশ্যে বাংলাদেশবিরোধী ও ছদ্ম বাংলাদেশবিরোধীদের পিছে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জামায়াত ’৭১-এ দেশে নরহত্যা করেছে। জামায়াত ও ছদ্ম বাংলাদেশ বিরোধীরা ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছে। এ দেশকে পাকিস্তানের অনুকরণে জঙ্গী রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছে। ২১ আগস্টের মতো গণহত্যা করেছে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তাই পরিবর্তিত এ বাংলাদেশে স্বাভাবিকই তাদের রাজনীতি করার অধিকার আর থাকছে না। নতুন প্রজন্ম তাদের রাজনীতি করার পরিবেশকে কঠিন করে দিয়েছে। নতুন প্রজন্ম দিনে দিনে দেশের রাজনৈতিক মনোভূমি এমন জায়গায় নিয়ে আসছে যে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে হবে। শতভাগ বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হবে। বিএনপি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ও হত্যার বেনিফিসিয়ারিদের একটি দল। জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে ব্যবহার করে তারা এই জাতিকে অনেক ধোঁকা দিয়েছে। ১৯৯১ সালে একটি নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় এসে এ জাতিকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে একটি মিথ্যা ও অসৎ বিতর্কের ভেতর ফেলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এভাবে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করে বিএনপি। তরুণ প্রজন্ম দশ বছরের বেশি সময় ধরে ওই বিভ্রান্তিতে ভুগেছে। পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ব্যাপক শুরু হয়। অন্যদিকে ২০০১ এর জামায়াতকে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ বানিয়ে দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র বানানো চেষ্টা শুরু হলে তরুণ প্রজন্ম বিএনপির প্রকৃত চরিত্র আরও বেশি উপলব্ধি করে। তরুণ প্রজন্মের এ উপলব্ধির প্রতিফলন দেশের মানুষ ২০০৮ এর নির্বাচনে দেখতে পায়। ২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৮টি আসন পায় এবং দেশের সকল রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্বীকার করেন বিএনপি থেকে তরুণরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে বিএনপির এই করুণ অবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৮ সালেই বিএনপি সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার আইনগত বৈধতা হারায়। ২০০৮ এ বিএনপিকে যে তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করে এ উপলব্ধি থেকে বিএনপি নিজেকে কোন সংশোধন করেনি। বরং আঁকড়ে থাকে সেই রাজনীতি অর্থাৎ জাতিকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি ও জামায়াতের সমান্তরাল রাজনীতি। তারা তাদের উপলব্ধিতে আনে না এ কারণে দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বরং আরও তারা বেশি নিজেদের জামায়াতী হিসেবে তৈরি করতে থাকে ও জামায়াতের মত ও পথে চলা শুরু করে। দেশের তরুণ প্রজন্মের দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা। শেখ হাসিনা তরুণ প্রজন্মের দাবি পূরণে এগিয়ে যান সব বাধাকে উপেক্ষা করে, অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতের ক্যাডারদের সঙ্গে তাদের ক্যাডারদের নামিয়ে দেয় দেশজুড়ে সন্ত্রাস করার জন্য। এমনকি তারা জামায়াতের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে প্রকাশ্যে বিদেশে লবিং করা শুরু করে। এর ফল কী দাঁড়ায়? গোটা বিশ্ব যে সময়ে ইসলামী জঙ্গী ও সন্ত্রাসে ভুগছে সে সময়ে বিএনপি ও জামায়াত বাংলাদেশের মতো একটি ১৫ কোটি মুসলিমের দেশে ইসলামিক জঙ্গী হামলাকারী গড়ে তুলতে থাকে। প্রকাশ্যে দেশে বিদেশে এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার ফলে বিএনপি ইসলামিক জঙ্গী দল হিসেবে স্বাভাবিকই চিহ্নিত হয়ে যায়। তাই আজ কেউ বিএনপির বন্ধু নয়। কী ইউরোপ, কী এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা কোথাও তাদের বন্ধু নেই। সৌদি আরব নিজেই ইসলামিক জঙ্গীর ভয়ে ভীত, তারাও বিএনপিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনাতে তারা শতভাগ আস্থা শুধু রাখেনি, মুসলিম বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম নেতা হিসেবে তারা স্বীকার করে নিয়েছে। এভাবে বিদেশে যেমন বিএনপি সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় তেমনি দেশেও তাদের অবস্থা ২০০৮ এর থেকে আরও খারাপ হতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। ২০১২ ও ’১৩ সালে বিএনপি ও জামায়াত মিলে দেশব্যাপী পেট্রোল সন্ত্রাস ও সাতকানিয়া, সাতক্ষীরায় যে সর্বাত্মক সশস্ত্র সন্ত্রাস চালায় তার ফলে তারা তরুণ প্রজন্মের মন থেকে আরও দূরে চলে যায়। আর ২০১৫তে এসে বিএনপি নেত্রী যে সময়ে প্রকাশ্যে অফিসে বসে সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দেয় তার পরের অবস্থা কী সেটা এবার নির্বাচনের আগে বিএনপি নিজেই প্রমাণ করেছে। তাদের নেতারা এবার কামাল হোসেনের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গড়ে, ড. কামালকে নেতা মেনে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিএনপির মানুষের কাছে যাওয়ার কোন মুখ নেই। ড. কামালের মুখের ওপর ভর করে তাদের মানুষের কাছে যেতে হয়েছে। এর বিপরীতে বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা অনেক কথা বলতে পারেন তবে তার আগে বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত। বিএনপি যে ২০০৮ থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার প্রমাণ ২০০৯ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের ডাকে রাজপথে কেউ নামেনি। বরং দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর নামে চাঁদ দেখিয়ে জামায়াত যখন সন্ত্রাস শুরু করেছিল তারা সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ত্রাস করে। আবার তাদের এক নেতা মাহমুদুর রহমান মাদ্রাসার নেতাদের বিভ্রান্ত করে হেফাজতী নামে ঢাকায় সন্ত্রাস করার জন্য নিয়ে আসে, তাদের সকল অর্থ জোগান দেয়, তার আমার দেশ পত্রিকা ও অফিস দুই কাজে লাগায় ওই সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর জন্য। ওই সময়ে হেফাজতের সন্ত্রাসকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় বিএনপি নেত্রী। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ২০০৮ থেকে ১৩ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলা করা ও সমর্থন করা ছাড়া বিএনপি মানুষের সমর্থনে কোন কিছুই করতে পারেনি। বিএনপি ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে নানান প্রশ্ন তোলে সব সময় কিন্তু তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। তারা বুঝতে চায় না, নির্বাচন নিয়ে তারা যতই প্রশ্ন তুলুক, আওয়ামী লীগের সরকার গঠন নিয়ে তারা যতই প্রশ্ন তুলুক- তাদের প্রতি মানুষের কোন সমর্থন নেই। মানুষের সমর্থন থাকলে কী হয় সেটা বিএনপিরই সব থেকে ভাল জানার কথা। বিএনপি তো আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচন করেছিল, ক’দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল? নির্বাচনের পরের দিন থেকে মানুষ রাজপথে নেমে গিয়েছিল। আর মাত্র ১৫ দিনের সংসদেই শেষ হয়ে যায় বিএনপির সে সরকার। বাস্তবে নির্বাচনের পরের দিন থেকে জনতা ক্ষমতা হাতে তুলে নেয়, যার সাংগঠনিক রূপ পায় জনতার মঞ্চ। আর জনতার মঞ্চের জনতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় বিএনপি সরকারকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যে দুটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলছে এই দুটি নির্বাচনের একটিরও বিরুদ্ধে বিএনপি একজনও মানুষ নামাতে পারেনি রাজপথে। এতে প্রমাণিত হয়, নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্নই থাকুক না কেন মানুষের সমর্থন আওয়ামী লীগের দিকে। আর বর্তমানে বিএনপির অসহায় অবস্থা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়, ২০০৮ এ যারা মাত্র ২৮টি আসন পেয়েছিল ২০০৯ থেকে ১৮ পর্যন্ত যে সন্ত্রাসী কাজ করেছে তাতে পাঁচ সাতটির বেশি আসন পেতে পারে না। দেশের মানুষের আস্থা যেমন হারাবে তেমনি বিদেশেও তারা বন্ধুহীন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিছু অন্ধ বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা বিএনপির এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছে না। তবে বিএনপির সিনিয়র ও মধ্যম সারির নেতারা এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এটা বুঝেছেন খুবই ভালভাবে। আর জাহাজের ইঁদুরের মতো বিষয়টি টের পেয়ে গেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। যে কারণে দেখা গেল যেখানে নির্বাচনের আগে ড. কামাল বলছেন, এই সরকার আর মাত্র ১৬ দিন ক্ষমতায় আছে অথচ বিএনপির অনেক ব্যবসায়ী নেতা তার আগের থেকেই নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যবসায়ী মহলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বিএনপি করতেন এমন ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই নানান পথে বিএনপি থেকে সরে আসছেন। আলী আসগর লবির মতো যারা প্রকাশ্যে বিএনপি নেতা ছিলেন তারা এখন সব একে একে পদত্যাগ করার পথে। পদত্যাগ করবে সারাদেশের মধ্যম সারির নেতারাও। এটা এখন সময়ের বিষয় মাত্র। এমনকি বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকরা খোলা চোখে বোঝার চেষ্টা করতে পারেন, সালমান রহমানের কাছে মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের বিনীত ভুল স্বীকার করার বিষয়টি। যে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো দিনের পর দিন সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতার সব ধরনের রীতি ভেঙ্গে নিউজ করেছে- তাদের সম্পাদকদের এই আত্মসমর্পণকে বিএনপি সমর্থকরা ‘পদত্যাগ’ হিসেবে দেখতে পারেন। কারণ যারা অন্ধ নন, তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন বিএনপি নামক দলটির আর কোন ভবিষ্যত নেই বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার প্রকৃত ধারায় নিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম যে গতিতে বাংলাদেশকে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে ওই গতিবেগের সামনে ’৭৫-এর প্রতিবিপ্লবী ধারা আর টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে অনেকে মনে করতে পারেন আওয়ামী লীগের বিপরীতে শূন্যতা পূরণের কারণেই বিএনপি টিকে থাকবে। বাস্তবে তরুণ প্রজন্ম প্রতিবিপ্লবী ধারাকে সে সুযোগ দেবে না। আওয়ামী লীগের বিপরীতে শূন্যতা পূরণ হবেই তবে সেটা আমেরিকার রিপাবলিকান বা ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির মতো কোন রাজনৈতিক দল দিয়ে। জাতির জনক ও সংবিধান হত্যাকারী প্রতিবিপ্লবী চত্রু আর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে টিকে থাকতে পারবে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে, জাতির জনকের জন্ম শতবর্ষকে সামনে রেখে জাতীয় জীবনে এ পরিবর্তন সত্যিই দ্বিতীয়বারের মতো দেশকে স্বাধীনতার আনন্দ দেবে। [email protected]
×