ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

একুশ বাঙালীর অহংকারের প্রতিচ্ছবি

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 একুশ বাঙালীর অহংকারের প্রতিচ্ছবি

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল একটি বহুমাত্রিক গণজাগরণ! যা চূড়ান্ত প্রভাব ফেলেছিল সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত হয়েছিল মাতৃভাষার অধিকার। মাতৃভাষাকে ভালবেসে বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মদানে সিক্ত আমাদের এই বর্ণমালা। একুশ শব্দটি তাই শুধু একটি সংখ্যা নয়, একুশ বাঙালীর অহংকারের প্রতিচ্ছবি। যে কোনও জাতির জন্য তার মাতৃভাষা নিঃসন্দেহে বিশাল গুরুত্ব বহন করে। সে দিক বিবেচনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, জাতি হিসেবে যেমন আমাদের গর্বিত করেছে তেমনি ভাষাপ্রেমীদের অনুপ্রাণিত করেছে। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য এমন আত্মোৎসর্গের ইতিহাস বিরল। পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি উদযাপন করা হয়। বস্তুত, তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের ফলেই যেমন রক্ষা পেয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতির জীবনের এমন এক ঘটনা, সরকার দাবি মেনে নেয়ার পরও তার চেতনা শেষ হয়ে যায়নি। ওই আন্দোলন বাঙালীদের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সেই চেতনাই জন্ম দেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের যা পরিণতি লাভ করে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের মধ্য দিয়ে। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালী সত্তায় মিশে আছে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের এই গর্বের অর্জনটি ধীরে ধীরে মর্যাদা ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত এ ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা ও বিশ্বমানের সাহিত্য সম্ভার। এসবই বাংলা ভাষার আবেদনময়ী ইতিবাচক উপাদান। এছাড়া সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ কোটি। সুতরাং এ দিক থেকে পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম। এত বিপুলসংখ্যক ভাষাভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। যেখানে বিশ্বব্যাপী শত শত ভাষা নিজস্বতা হারিয়ে বিপন্ন প্রায়, অথচ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার। তবে এতসব অর্জনের পরও আমাদের চেতনার অগ্নিশিখা ‘বাংলা ভাষা’ তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। দৃশ্যত মাতৃভাষার জন্য আমাদের ভালবাসার কমতি নেই বিন্দু মাত্র! প্রতিবছর একুশ এলে হাতে হাতে শ্রদ্ধার ফুল আর শোকের কালো পোশাকে সে ভালবাসার বহির্প্রকাশ দেখতে পাই। তবে শোক ও শ্রদ্ধার এই বন্ধনকে আমরা সারা বছর লালন করি না আমাদের মুখের ভাষায়। রাষ্ট্রভাষা থাকে নামে মাত্র! রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারপতি, আইনজীবী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা লিপ্ত থাকেন ভিনদেশী ভাষা ব্যবহারে। ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশ থেকে ঔপনিবেশিক ধারার মূলোৎপাটন হলেও এর প্রভাব থেকে গেছে আমাদের অফিস আদালত, শিক্ষা ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে। অথচ জাপান, উত্তর কোরিয়া চীন ইংরেজী ভাষার প্রবল প্রতিপত্তিকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় ও দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাফতরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাভুক্ত ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা দেয়া হয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেই ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ বাংলাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। বিশ্বব্যাপী এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। কিন্তু আমাদের প্রাণের ভাষা নিজ ভূমিতেই কতটা যে অবহেলার স্বীকার, তার নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠ্য-পুস্তক খুললে শিশুদের জন্য ভুল বানান আর ভুল বাক্যের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য এটা সুখকর নয়। ভাষা তার স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবর্তিত হবে, কিন্তু জোর করে বা চাপিয়ে দেয়া মেনে নেয়া যায় না। বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ ও বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে ও মর্যাদা রক্ষায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ইং তারিখে প্রদত্ত নির্দেশনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×