ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

সংস্কৃতিতে মাটির ঘ্রাণ

প্রকাশিত: ১২:২৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 সংস্কৃতিতে মাটির ঘ্রাণ

কালো ছাঁয়ায় ঢাকা পড়েছিল অনেকটা সময়। অপসংস্কৃতি ও মিথ্যা দিয়ে সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল আমার বাংলার ঐতিহ্যকে। নতুন প্রজন্মকে সচেতনভাবে ভুল পথে হাঁটাতে বাধ্য করা হচ্ছিল। অস্থিরতার বেড়াজাল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল সমাজকে। মানুষ যেন আত্মিক ক্ষুধায় ভুগছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু সময় যে পরিবর্তনশীল। সত্য চাপা থাকতে পারে না। ইতিহাস অপরিবর্তনীয়। সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। আমরা ফিরে পাচ্ছি সংস্কৃতিতে মাটির ঘ্রাণ। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হয়েছে ‘সংস্কার’ শব্দ থেকে। ‘সংস্কার’ অর্থ শুদ্ধি, মার্জন, ব্যাকরণাদির শুদ্ধি, ভুল সংশোধন, স্বভাবসিদ্ধ স্থায়ীভাব। আর সংস্কৃতি হলো মানুষের বিশ্বাস, জ্ঞান, আচার-আচরণ, রীতিনীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, অর্জিত কীর্তিসমূহ। সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার হয়। ইংরেজী ‘কালচার’ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে শব্দটি অভিধানে যুক্ত হয়েছে। সংস্কৃতিকে সহজভাবে বলতে গেলে এটি এক ধরনের টিকে থাকার কৌশল। আর এই কৌশলগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনে সামাজিক, ভৌগোলিক অবস্থানভেদে নির্মিত করেন যা যুগ-যুগান্তর ধরে চলে। পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনে সেই কৌশলে সংযোজন বিয়োজন ঘটে। এই অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে আরোপিত যা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আবার অর্জিত। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের ভাষ্যমতে ‘সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হলো সংস্কৃতি।’ ম্যালিনোস্কির বক্তব্য মতে ‘সংস্কৃতি হলো মানবসৃষ্ট এমন সব কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।’ স্যামুয়্যাল পুফেনডর্ফের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সংস্কৃতি বলতে সেই সকল পন্থাকে বোঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে ওঠে এবং ছলনাময় কৌশলের মাধ্যমে পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়।’ মূল অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে প্রাগ্রসরমানতার ধারণা, হাজার বছরের অভিজ্ঞতা, আবার সংস্কৃতি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। সংস্কৃতি বিষয়টি ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি নৃবিজ্ঞানীরাও বিশেষভাবে গবেষণা করেন। নৃবিজ্ঞানের দ্বিতীয় প্রধান শাখা হলো সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান আবার তিনটি উপশাখায় বিভক্ত যেমন প্রত্ন বিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান ও জাতিবিজ্ঞান। এই তিনটি উপশাখাই মানুষের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। এগুলো থেকে কোন নির্দিষ্ট সমাজের চিন্তাধারা ও আচরণের রীতিনীতি বুঝতে পারা যায়। প্রত্নবিজ্ঞানীরা প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের দৈনন্দিন জীবন এবং রীতিনীতি তাত্ত্বিকভাবে পুনর্গঠন করতে চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও তারা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অনুসরণ করেন এবং এই পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তারা পুরনো মনুষ্য সংস্কৃতিগুলোর অবশেষ থেকে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালান। নৃতাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানীদের একাংশ ভাষার আবির্ভাব এবং সময়ের সঙ্গে ভাষার বিস্তার নিয়ে আগ্রহী; এই ক্ষেত্রটি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান নামে পরিচিত। তারা সমকালিক ভাষাগুলো কীভাবে একে অপরের থেকে আলাদা, তা নিয়েও গবেষণা করেন; এই গবেষণা বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। এ ছাড়া তারা সমাজে ভাষার প্রকৃত প্রয়োগ নিয়েও আগ্রহী; এই ক্ষেত্রটির নাম দেয়া হয়েছে সমাজ ভাষাবিজ্ঞান। বর্তমান ও নিকট অতীতের জাতিগুলোর রীতিনীতি, চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্মের মধ্যে কী পার্থক্য আছে এবং কেনই বা এই পার্থক্য হয়, তা জাতিবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। জাতিবিজ্ঞানীদের একাংশ জাতিবিবরণে আগ্রহী; একজন জাতিবিবরক কোন একটি সমাজে গিয়ে বছরখানেক বাস করেন, কথা বলেন এবং সেই সমাজের রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সামাজিক দলটির একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিগত বিবরণ প্রস্তুত করেন। আরেক ধরনের জাতিবিজ্ঞানীর নাম জাতি-ইতিহাসবিদ; এরা লিখিত দলিলপত্র অনুসন্ধান করে সময়ের সঙ্গে কোন একটি নির্দিষ্ট জাতিগত দলের জীবনধারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। তৃতীয় আরেক ধরনের জাতিবিজ্ঞানীকে বলা হয় আন্তঃসাংস্কৃতিক গবেষক; এরা জাতিবিবরক ও জাতি ইতিহাসবিদদের উপাত্ত থেকে কিছু সংস্কৃতির নমুনা নেন এবং কোন ধরনের রীতিনীতি সাধারণভাবে সব ধরনের সমাজে প্রযোজ্য, তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। নৃবিজ্ঞানের গবেষণা মানুষকে সহিষ্ণু করতে সাহায্য করতে পারে। অন্য জাতির লোক কেন সাংস্কৃতিক ও দৈহিক দিক থেকে আলাদা আচরণ করে, নৃবিজ্ঞান তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়। যেসব সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও কাজকর্ম আমাদের কাছে ভুল বা অশোভন মনে হতে পারে, সেগুলো হয়ত বিশেষ পরিবেশগত বা সামাজিক অবস্থার জন্য অভিযোজনের ফসল। বাংলাদেশের সংস্কৃতি নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত যেমন : সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, গণমাধ্যম, সামাজিক অনুষ্ঠান, নাটক, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ক্রীড়া ও লোকজ সংস্কৃতি। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পথচলা হাজার বছর ধরে। চর্যাপদ হচ্ছে এর আদি নিদর্শন। মধ্যযুগে বাংলাভাষায় কাব্য লোকগীতি ও বিভিন্ন পালাগানের প্রচলন ঘটে। অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলা ও যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মীয় কাব্য দিয়ে অর্থাৎ ভক্তিবাদী চেতনাই ছিল মূল উপজীব্য। সুফীবাদের উদ্ভবও সে সময়। যেমন : বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা ও সাথীভাবকের মতো সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ। এরই মধ্যে কিছু রোমান্টিক কাব্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত কাজী এবং আলাওলের কাব্য গ্রন্থে। এরপর উনিশ শতকের ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালী কবি এবং লেখকরা মানবতা ও নিজেদের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে তাদের লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে শুরু করেন। যা হয় মানবমুখী। সাহিত্যের বিষয়বস্তু তথা মূল ভাবধারায় আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বঙ্গীয় রেনেসাঁর সূচনাকাল মূলত ওই সময়টাই। এতে অবদান রেখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আনুষ্ঠানিক তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বদৌলতে এবং ছাপাখানার প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীলতার ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। লিপিবদ্ধ হতে থাকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তখন থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত অনেক মুসলমান সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেন। এদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন অন্যতম। একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি গঠনে এগিয়ে চলে। সামাজিক চিত্র ফুটে উঠতে থাকে সাহিত্যে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। অনেক নামকরা লেখক তৈরি হয়ে যায় যারা সংস্কৃতিকে লালন ও উন্নতমাত্রায় নিয়ে যায়। একটি চলমান প্রক্রিয়ার মতো সাহিত্যের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হওয়ার পরও হঠাৎ করেই এর ছন্দ পতন ঘটে। বিগত তিন দশক ধরে যেন এক অদৃশ্য সঙ্কট ছন্দের পতন ঘটিয়েই যাচ্ছে। মানুষের মানবিক অবক্ষয় বেড়েই চলেছে। নৈতিকতার কাছে মানুষ হয়ে যাচ্ছে অসহায়। সৃষ্টি হচ্ছে না কালজয়ী কোন কাব্যগ্রন্থ উপন্যাস। আমাদের সংস্কৃতি যেন কোথাও দিকভ্রম হয়ে যাচ্ছে। আজ সংস্কৃতি বিনষ্ট হলে এর প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য। সংস্কৃতি ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করে। সংস্কৃতি যখন অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয় তখন এর ভবিষ্যত অন্ধকার। আমাদের ঐতিহ্য মৈমনসিংহ গীতিকা। এ ছাড়া লোকসঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে বাউল জারি, সারি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি। আধুনিক গানও আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চা না করলে তাকে লালন না করলে ধারণ করা সম্ভব নয়। শেকড় সন্ধানী অনুপ্রেরণা অবশ্যই থাকা আবশ্যক। নইলে নব নব শিল্প যুগোপযোগী হবে না। বাংলা গানের ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। শুধুমাত্র অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য। চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালীর জীবন দর্শন। যাযাবরের মতো এদিক ওদিক হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছি। সবই ফাঁকা, যেন শেকড় ছাড়া বৃক্ষে পরিণত হয়েছি। আজ আমরা নতুন প্রজন্মকে ভোগবাদী সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শিখাচ্ছি নব নব কৌশল, যা নৈতিকতাবোধকে গলাটিপে হত্যা করছে, মানবীয় হতে বাঁধা দিচ্ছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা বলতে এখন আর কিছু নেই। সবাই নিজ নিজ অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে ব্যস্ত। সংস্কৃতি কোন নির্দিষ্ট সূত্রে বাঁধা নয়। এটি নিয়ত পরিবর্তনশীল। তবে সেই পরিবর্তন সব সময়ের জন্যই সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য হবে। নিজস্ব সংস্কৃতির অলঙ্কার হিসেবে নতুন নতুন শাখা সৃষ্টি হবে যা পরবর্তী প্রজন্ম আদর্শ ও ঐতিহ্য হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একেই বলা হয় সংস্কৃতির আধুনিকীকরণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা মনে হচ্ছে আবার সঠিক পথে চলতে শুরু করছি। উৎসবগুলো যেন ফিরে পাচ্ছে নিজস্ব ঢং। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ বহন করে। পুরনো সব সাংস্কৃতিক অনুসর্গগুলো গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রকৃতরূপেই প্রজন্মের কাছে উঠে আসছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, গণমাধ্যম, সামাজিক অনুষ্ঠান, নাটক, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ক্রীড়া ও লোকজ সংস্কৃতি সব কিছু ডিজিটাল ফরমেটে ছোট্ট মোবাইল ডিভাইসেও দেখার উপযোগী করা হচ্ছে। সময় বা প্রযুক্তির অগ্রসরতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই সবকিছু যুগোপযোগী করে তোলাটাই হচ্ছে সঠিকভাবে সংরক্ষণের পন্থা। আমরা সে পথেই হাঁটছি।
×