ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুশান্ত মজুমদার

আয়ুষ্মান ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আয়ুষ্মান ভাষা আন্দোলন

গত শতাব্দীর বিভাগোত্তর সময়ে জোরালো হতে থাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ন্যায্য দাবি। অধিকারের এই ঘোষণা প্রথমে ছিল দূরদর্শী-সজ্ঞান-বিদ্বান মুষ্ঠিমেয় মানুষের আকাক্সক্ষার বিষয়। ক্রমশ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভাব প্রকাশের রীতি বজায় রাখতে প্রজালোক দলবদ্ধ হয়। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারী বাহিনীর রক্তাক্ত হত্যাকান্ডে জাতি সর্বোচ্চ ক্ষুব্ধ হয়ে মিছিল স্লোগানে রাজপথে নেমে আসে। উপেক্ষা করে শাসক ও তাঁর পেটোয়াদের ভ্রুকুটি। জন্মেই আমাদের যে প্রাপ্ত মাতৃভাষা তা নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ষড়যন্ত্র, অপশাসনে-ভাষণে-রাজনৈতিক কূটকৌশল, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পাওয়ার জন্য বাঙালীদের ওপর উপর্যুপরি নির্যাতন নেমে এলে প্রতিবাদে দেশবাসী রুখে দাঁড়ায়। শেষাবধি ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাঙালীর ওপর চাপিয়ে দেয়া শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষকে করে অভেদ একত্ব। জন্মভাষায় আমরা কথা বলি, লিখি, ভাবের আদান-প্রদান করি তার সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের কোটি মানুষ। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ভাষাভিত্তিক শহীদ দিবসই ক্রমশ হয়ে ওঠে এই কোটি বাঙালীর আত্মপরিচয়-আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান উপাদান। ভাষা আন্দোলনের গর্ভে বাংলাদেশের ভ্রুণ ধীরে ধীরে বড় হয়ে জন্ম দিয়েছে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্ত, শহীদী জীবন উৎসর্গ, সংগ্রাম-বিক্ষোভের উত্তাপ গ্রহণ করে বাঙালী হয়ে ওঠে আপোসহীন। শহীদ দিবসের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান সরকার, তাদের বিভিন্ন বাহিনী ও এ-দেশীয় জনবিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়াশীলরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ সাধারণ নিরপরাধ মানুষের জীবনে গেছে। ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলার এমন কোন অঞ্চল ছিল না যেখানে বাঙালীর রক্ত ঝরেনি। এখানে প্রতিপক্ষ বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির মতো সেই পাকিস্তান, সামরিক বাহিনী এবং এ-দেশীয় দালাল। ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক মেরুকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে নিজেদের বিষয় ভেবে এবং ভবিষ্যত প্রত্যাশায় বাঙালী সাড়া দেয়। ভাষা আন্দোলন ও একাত্তর তাই একাকার। আমাদের জাতীয় জীবনে নিশ্চিত পালনযোগ্য হচ্ছে- শহীদ দিবস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস। তন্নিষ্টের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী-মফস্বল শহর-দূরের গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছায় সাড়া দেয় বেশি। অন্যান্য দিবস পালনে তৎপরতা, আনুষ্ঠানিকতা ও মানুষের উপস্থিতি থাকলেও শহীদ দিবসে জোয়ার ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতার। ব্যতিক্রম, বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে আমাদের আছে শত বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বন্ধন। এর সঙ্গে রয়েছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নিবিড় সম্বন্ধ। এখানে প্রতিরোধ ও যুদ্ধের সম্পর্ক নেই। বাঙালীর মরণপণ লড়াই হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম এই ভূখন্ডে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনে আমরা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে আমাদের চরম ত্যাগ। কিন্তু এতো বছরেও স্বাধীনতা আমাদের জীবনে পুরোপুরি অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। কালক্রমে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, চাপা পড়া নিম্ন বর্গজন কিংবা শ্রমজীবীরা স্বাধীনতা থেকে প্রয়োজনীয় সুফল পায়নি। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েও জীবিতজনরা স্বাধীনতা নিংড়ে উপযুক্ত শাঁস আহরণ করতে পারেনি। বিজয় দিবসের বিজয় থেকে গেছে অল্পসংখ্যকের উন্নতি প্রতিষ্ঠায়। শহীদ দিবসের মর্মার্থ সুদূরপ্রসারী, মহিমাময়, প্রভাবসম্পন্ন, তলদেশস্পর্শী হওয়ায় মানুষের মনে অনিঃশেষ স্পন্দিত হয়। এদেশের সব মানুষ এখন জানেন যে ভাষা আন্দোলন আমাদের নিজস্ব দেশ ও স্বাধীনতার জন্য পালন করেছে প্রধান নক্ষত্রের ভূমিকা। চিন্তা- চেতনা-জাগরণ ও জাতির উত্থানের ক্রমাগ্রগতির সঙ্গে রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির শক্তি। এখানে চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে অন্তর্গত তাগিদ ও চৈতন্যের সঞ্চার হয় অধিক। রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি টান-ভালবাসা, সংহতি জ্ঞাপন, নিজের মধ্য থেকে দেয়া ও নেয়ার অন্যতম বিষয়। আমরা দেখি, প্রতিবছর গ্রাম-গঞ্জ, শহরের বস্তি এলাকাতেও মাটি, কুড়ানো ইট দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে শিশু-কিশোররাও সাধ্যমতো শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছে। কেউ তাঁদের বলে দেয়নি, নির্দেশ দেয়নি- সম্মিলিতভাবে স্মরণীয় দিনটি পালনে ছোট ছোট অনুষ্ঠান করছে। সাতষট্টি বছর হলো শহীদ দিবসের বয়স। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে দেশ ভেঙ্গে নতুন দেশ হলো। জাতির জীবনে নতুন দেশের জন্য রচিত হয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। দেশকর্তা, কত সরকার এলোগেল। আমাদের শাসন করেছে বিভিন্ন পদ্ধতির সরকার। সমাজের উপর কাঠামোতে বহুবিধ পরিবর্তন ও নির্মাণ। মানুষের মুখের পাশ থেকে উঠে এসেছে নতুন মুখ। বদলেছে আমাদের স্বভাব-প্রবৃত্তি-রুচি-অভ্যাস। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, অবৈধ হত্যাকান্ড, বিপদগামীদের দ্বারা সংঘটিত জনসমর্থনশূন্য রক্তাক্ত অভ্যুত্থান বিঘ্নিত করেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক যাত্রা। এখনও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বর্জনের নামে জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ দেখা যায়। স্বাধীনতা ও বিজয়ের ভেতরের শাঁস আমরা দেখতে পাই না। শাসনশূন্য ভাষণ আমাদের কবলিত করে- বঞ্চিত থেকে যায় মানুষ। আমাদের মধ্যে কেবল কথাই জমে, এর চাপে আয়ু কমে আসে, জীবনের জন্য উপযুক্ত বাতাসও পাই না। এর প্রতিকারে প্রবল বিরোধিতার মুখে টিকে থাকার জন্য আমাদের প্রথম সংগ্রাম ভাষা আন্দোলনের চেতনার কাছে ফিরে যাই। আমাদের জড়তা, নিরুদ্যম, মিইয়ে যাওয়া জীবনযাপন ভেঙ্গে দিয়ে উদ্দীপনা এনে দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি। এত বছর পরও তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও চিন্তা-চেতনা-বোধে যে টোকা পড়ে তার সঙ্গে ধরা পরে একুশের প্রতি নির্ভেজাল আগ্রহ। এমন ঐকান্তিক মনোযোগ, বিচার-বিশ্লেষণ কেবল কী শিক্ষিতজনরা করেন? ব্রাত্য করে রাখা, আচারভ্রষ্টের নামে দলিত মানুষের একটাই সম্বল- মনে মনে সম্ভবপর সমর্থন ও সঙ্গী হওয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে তাই ঘাটতি দেখা যায় না। দেশের সর্বত্র আগামীতেও সাধারণের শহীদ দিবস পালিত হতে থাকবে। উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মীয় উত্তেজনার ছুরি-কাঁচি দিয়ে টুকরো করা হয়েছিল অখন্ড দেশ। নকল ও ভ্রান্ত তাহজিব, বানোয়াট তমদ্দুনের সঙ্গে ইসলামী জোশ রাজ্যপাটে ছড়িয়ে দেয় সাম্প্রদায়িকতা, মানসিকতায় বিভেদাত্মক আচার-ব্যবহার। ভাষা আন্দোলনে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি, মনোযোগ, দূর হতে থাকে প্রাক্তন ধারণা, মনোজগতের কলঙ্ক, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। ধর্মীয় পরিচয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের বেঁধে রাখার মধ্যযুগীয় অনিষ্ট ও অপ্রক্রিয়ায় অপচয় হয়েছে ক্ষমতা। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন কুক্রিয়াশীল প্রভুদের এই ক্ষমতা, সামর্থ্য ও প্রভাব জেগে ওঠা বাঙালীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আন্দোলন আমাদের অন্তর্জগতকে পরিশুদ্ধ করে- খুলে যায় মনশ্চক্ষু। বাঙালী ফিরে পায় তাঁর পরম্পরাগত ধারা, কয়েক শতাব্দীর প্রাণরাঙা ঐতিহ্য, ধর্মসম্প্রদায়গত সদ্ভাব। ঐক্যবদ্ধ বাঙালী হচ্ছে উজ্জ্বল গৌরবময় ইতিহাসের প্রণেতা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অসম্প্রদায়িক উপলব্ধি ও অনুশীলনের অর্জন তা পরবর্তীকালে সমগ্র জাতির জীবনে সরবরাহ করে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব। সেই অসম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তাবাদই হচ্ছে জাতির প্রাণভোমরা।
×