ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

বাংলার শ্রেণীচেতনা এপার ওপার একুশে

প্রকাশিত: ১২:৩১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলার শ্রেণীচেতনা এপার ওপার একুশে

বাহন উপযুক্ত না হলে কেউ তার উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে পারে না। লক্ষ্য লাভ করতে হলে সাহিত্যের বাহন উপযুক্ত হওয়া চাই, যে বাহন হবে মাতৃভাষা- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবার ওপার দুপার বাংলা। সাতচল্লিশ। পার্টিশন। দেশভাগ। মধ্যরাতে অখন্ড ভারতের মানচিত্রের ওপর র‌্যাডক্লিফ সাহেবের বেপরোয়া কালির আঁচড়। সীমানা নির্ণয়। পূর্বদিকের বাংলার নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান। মাতৃভাষা বাংলার তখন সঙ্কটজনক পরিস্থিতি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পরেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে ঘিরে ঐতিহাসিক আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে চেতনার সূচনা। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ পরবর্তীকালে নিজস্ব ভূখন্ডের মর্যাদা রক্ষার যে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছেন তার সূচনা কিন্তু এই একুশেই। একুশ প্রতিবাদের প্রেরণা। বাংলা ভাগ হলেও দুই বাংলার ভাষা এক। নীল জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে একই আকাশ। একই সংস্কৃতি। একই সামাজিক আচরণ। একই মানসিকতা। একই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। দুই বাংলা গান গায় একই সুরে। ঝড় উঠলে বোঝে কেউ কারও নয় দূরে। দুই বাংলার, বাঙালীর আবেগ তাই সহজাত। স্বাভাবিক। চল্লিশের দশকে মুসলিম মধ্যবিত্ত যে আবেগের টানে দেশভাগে উজ্জীবিত হয়েছিলেন, পৃথক সত্তার গর্ব অনুভব করেছিলেন- মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সেই স্বপ্নের মোহভঙ্গ ঘটেছিল। বাঙালীর জাতীয়তাবাবোধের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও মহিমান্বিত। সেই জাতীয় সত্তাকে অস্বীকার করে ধর্মীয় প্রাধান্যকে সংস্কৃতিসম্পন্ন রুচিশীল বাঙালী কখনই মেনে নিতে পারেনি। ফলে দেশভাগের এক বছরের মধ্যেই শুরু হলো মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার লড়াই। একুশের বিদ্রোহ ভূগোল মেনেছে, কিন্তু তাই বলে এই বিদ্রোহ নির্দিষ্ট কোন সীমারেখায় আবদ্ধ নয়, এ বিদ্রোহ আঞ্চলিক নয়- এ বিদ্রোহ গণতান্ত্রিক। এ বিদ্রোহ সমষ্টিগত ঐক্যের। এ বিদ্রোহ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধেও। ‘বাঙালী মুসলমান আগে মুসলমান এবং পরে নিতান্ত অনিচ্ছায় বাঙালী, যেহেতু তার মাতৃভাষা বাংলা এবং বাংলা হলেও মুসলমানি বাংলা’ এ সকল সামন্তবাদী পিছুটানের সামান্যতাকে সাহসের সঙ্গে ছিন্ন করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। একুশে ছিল বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগ। সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার। ভাষা দিবস মানেই এই শহীদ চতুষ্টয়। এর মধ্যে বরকত দেহে প্রাণে দ্বিখন্ডিত। তার স্মৃতিসৌধ এক বাংলার ঢাকাতে কিন্তু তার দেহ শুয়ে আছে আরেক বাংলার মুর্শিদাবাদে। দেশভাগ বাংলাভাগের পরে বরকত ছিলেন ভারতীয় ছাত্র যিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পড়তে গিয়েছিলেন ঢাকাতে এবং ’৫২-এর আন্দোলনে শহীদ হন। ফলে বাংলার বাঙালীকে দেখতে হলে শুধু উগ্র মোল্লা আর গোঁড়া কুলীন হিন্দু ধর্মান্ধদের দেখলে হবে না, দেখতে হবে বরকতকেই। দুই বাংলার এক অভিন্ন প্রতিনিধি এই বরকতই। আকাশভাঙ্গা বষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় বরকতের রক্তে পদ্মার এপার ওপার প্লাবিত। দেহ ছাড়া প্রাণ আমরা ভাবতে পারি না, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী বরকতের মন ঢাকার মাটিতেই। একুশের আন্দোলন শুধু শোকে ও আনন্দে শেষ হয়নি, তা পরিণত হয়েছে শপথে। তাই একুশের প্রাণ যেখানে ঐতিহ্য সেখানে- বিদ্রোহ। শুধু প্রতিবাদ নয়, ইতিবাচক বিদ্রোহেই। স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের বিদ্রোহ, অন্য সব দিনের চেয়ে তাই ঐতিহ্যগতভাবে আলাদা একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা নববর্ষের দিনটির চেয়েও স্বতন্ত্র একুশে- কারণ ওই বিদ্রোহ। সরকারী পুলিশ প্রশাসন দ্বারা এই বিদ্রোহ কিভাবে দমন করতে হয় সেই কাহিনী তার আত্মজীবনীতে সগর্বে লিপিবদ্ধ করেছেন কর্নেল আয়ুব খান। কুুশের আন্দোলন ছিল দেশপ্রেমিকদের অন্দোলন। ইতিহাস সাক্ষী দেশপ্রেমে বাংলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন ও সুবিখ্যাত। বাংলায় আগুন না জ্বললে ব্রিটিশরাও ভারত ছাড়ার কথা কোনদিন ভাবত না। একুশ ঠিক তেমনিই। একুশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, যা ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকদের। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন, ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।’ ‘এক্ষণে শুধু বঙ্গবাণী নয়, যারা বঙ্গে বাস করে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন, পরিবেশ, জনগণের বিরুদ্ধে মূল কল্যাণধারা বজায় রাখা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে তাদের উদ্দেশেও এই বাণী প্রযোজ্য। তবে বহু ত্যাগ তিতিক্ষা সংগ্রাম আত্মত্যাগের পর মায়ের ভাষাকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা গেছে, এই সময়ে অতি প্রয়োজনে এর সুমিত যথার্থ ও সাবলীল সম্প্রসারণ। রবি ঠাকুরের কথায়- ‘ইউরোপীয় বিদ্যা ইংরেজী ভাষার জাহাজে করে এ দেশের শহরে বন্দরে আসতে পারে। কিন্তু পল্লীর আনাচে কানাচে তাকে পৌঁছে দিতে হলে দেশী ডিঙ্গি নৌকার প্রয়োজন।’ ফরাসী গল্পকার আলফাস দোদের শেষ শিক্ষা গল্পটি শিক্ষণীয়। শিক্ষক পড়াচ্ছেন, তার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ভাষা। তিনি বলছেন যে জাগতিক সমস্ত সম্পদ হারিয়েও মানুষ পৃথিবীতে থাকবে যদি তার ভাষা সুরক্ষিত থাকে। আর যদি সেই ভাষা অবমানিত হয় তাহলে সে সবই হারাবে। ভাষার এমনই জোর। ১৮৯২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন- ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই, কে লিখিবে?’ অবশ্য তার অল্পকাল পরেই রবি ঠাকুর প্রমুখ বাঙালীর ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে। সেই প্রথম বাঙালী জাতি অভিপ্রায়ের একাত্মতা এবং জীবন সংগ্রামে বদ্ধপরিকর সংকল্পে যূথবদ্ধ হয়েছিল। এরপরে দেশভাগের অনতিবিলম্বেই পূর্ব বাংলার বাঙালী জাতি এক লক্ষ্যে এক অভিপ্রায়ে ১৯৫২ সালে আবার ইতিহাস নির্মাণ করল। দীর্ঘকাল ধরেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর উপনিবেশ গড়ার যে লালসা ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে এবং বহু লড়াই সংগ্রামে স্বাধীন দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে যে সব দেশ, তাদের অন্দরে কিন্তু রয়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সেই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদের জোরালো স্বর। রবি ঠাকুর বহু আগেই তার আগমন প্রত্যক্ষ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কিত হয়ে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, এক আইন এক প্রভু হলে স্বাধীনতার পক্ষে সঙ্কট। খ- খ- দুর্বল করে যে কোন দেশ ও জাতিকে গ্রাস আর অবাধ ভোগ করাটাই চরম লক্ষ্য। বর্তমানে সেই আশঙ্কাই সত্য। ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার অধিকার তো বটেই তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধিকার, কুসংস্কার থেকে মুক্তির মহৎ সব সঙ্কল্প। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান মৌলবাদী শক্তি মূল অক্ষর বজায় রেখে বাংলা ইসলামিক ভাষা তৈরির প্রকাশ্য স্পর্ধা দেখাচ্ছে, সেই ’৭১ ও তারা নজরুলের কবিতার ‘শ্মশান’ কেটে গোরস্তান করেছিল। তাই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা অনুযায়ী বলা যায়, ‘ষাট বছর পরেও ২১ ফেব্রুয়ারির দায়িত্ব এখনও কিছুমাত্র লাগব হয়নি।’ ভাষার নিজস্ব কোন শ্রেণী চরিত্র নেই কিন্তু ভাষার প্রয়োগেই শ্রেণী চরিত্র ধরা দেয়। কবি তার নাটকে শ্রমিক ফাগুলালের কণ্ঠে বলছেন, ‘চল সব, দলবল জুটিয়ে আনি, বন্দীশালা চুরমার করে ভাঙবই।’ আসলেই এটা শ্রেণীচেতনারই সংলাপ। সংগ্রামের ভাষা, দ্রোহের আহ্বান। কবি বিষ্ণু দে লিখেছেন, ‘কোথায় ঘোড়সওয়ার? দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী! বর্শা তোল। কোন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোল?’ একুশের আন্দোলন সেদিন যাদের বিরুদ্ধে ছিল আজও তাদেরই বিরুদ্ধে। ধনীর বিরুদ্ধে গরিবের লড়াই। একুশের আন্দোলন সংস্কারে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে সমাজবিপ্লবেই। একুশের দৃপ্ত পথে শ্রেণীচেতনার আলোকে এই লড়াই জারি থাকুক।
×