বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এটা খুবই দুঃখজনক যে, ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা বন্ধ হয়নি। এবার ইতিহাস বিকৃতির দায়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর যথাযথ ও যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে বৈকি। অন্যতম কারণ ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অন্তর্ভুক্ত না করা। নিঃসন্দেহে এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর অমার্জনীয়, এমনকি দ-নীয় অপরাধ। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ২০১৩ সালের জুনে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থের পা-ুলিপি প্রস্তুত ও প্রকাশনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সম্পর্কে উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটি নামে গঠিত হয় দুটি কমিটি। কমিটি দুটি পা-ুলিপি চূড়ান্তের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’। এর পরই জনসম্মুখে উন্মোচিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আসল চেহারা ও চরিত্র। বইটির ভাল-মন্দ বিচার্য যাই হোক না কেন, যেটি আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য তা হলো বইটির কোথাও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের ছবি স্থান পায়নি। অথচ গ্রন্থটিতে কুখ্যাত পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ইতিহাস ধিকৃত মোনেম খানের ছবি ঠাঁই পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নামকরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। পরিহাস এই যে, ইতিহাসের এহেন মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতি দেশ ও জাতিকে দেখতে হলো ২০১৭ সালে এসে বালাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ইতিহাসে, তাও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে। ইতিহাস বিকৃতির এই হীন প্রচেষ্টা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হলে আদালত অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে কৈফিয়ত তলব করে। অতঃপর এ নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি এবং সেই প্রতিবেদনও দাখিল করা হয় আদালতে। তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তাও হাস্যকর ও অগ্রহণীয়। উপদেষ্টা ও সম্পাদনা কমিটি নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধুর কোন ছবি খুঁজে পায়নি। অথচ তারা কুখ্যাত ও ধিকৃত আইয়ুব খান এবং মোমেন খানের ছবি খুঁজে পেয়েছে ও সেগুলো সসম্মানে ছাপিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে! তদন্ত কমিটির মতে এটি গাফিলতি ও সমন্বয়হীনতা। অন্যদিকে হাইকোর্ট বলেছে, বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এতে ইতিহাস বিকৃতি ঘটেছে। অতঃপর বইটি বাজেয়াপ্ত করে হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুর ছবি অন্তর্ভুক্ত না করার ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে বইটির সম্পাদনা পরিষদের প্রধান ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহাকে আগামী ১২ মার্চ আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে ইতিহাস বিকৃতির হীন অপচেষ্টার এই দায় শুধু কোন ব্যক্তির নয়, বরং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। মাথাভারি উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে ছাড় পেয়ে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। মনে রাখতে হবে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতাসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সুতরাং তাদের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহির আওতায় থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে এর যথেষ্ট ব্যত্যয় ঘটেছে।
ব্যাংকটির দুর্বল পরিচালনা ব্যবস্থাসহ সিবিএ-এর দৌরাত্ম্যের বিষয়টি সুবিদিত। এর বাইরেও সম্প্রতি রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছে দেশে-বিদেশে। মামলাও হয়েছে মার্কিন আদালতে। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ব্যাংকটিতে কর্মরত অনেকের নামও এসেছে। সরকার অবশ্য সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি জনসমক্ষে। যা হোক, সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করা না গেলে ইতিহাস বিকৃতিসহ আর্থিক অনিয়মের ঘটনা আগামীতেও ঘটতেই থাকবে- এমনটা কারও প্রত্যাশিত নয়।
শীর্ষ সংবাদ: