ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রং-বেরং জীবন যখন যেমন

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রং-বেরং জীবন যখন যেমন

জন্মের ৩-৪ বছর অবধি সময়কার কোন কথাই আমার মনে নেই। কারও মনে থাকে কিনা জানি না। পরিবারের ছোট্ট সন্তান হওয়া এবং নায়কোচিত চেহারা থাকার সুবাদে একটু বেশি আদরেই হয়ত বড় হয়ে উঠেছিলাম বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে। শুধু মনে পড়ছে সাত ভাই-বোনের সবার বড় ভাই এবং বৌদি ভারত থেকে বেড়াতে আসলে বাড়ির পশ্চিমের ঘরটায় থাকতে দিয়েছিল। বড় বোনও তখন জলপাইগুড়ি থেকে এসেছিল। আমার মনে পড়ছে এক রাতে বোনের বড় মেয়েটি উত্তরের বড় ঘরটিতে নেচেছিল। আমার বোনের মেয়েটি নাকি আমার চাইতে দুই মাসের বড় ছিল। অর্থাৎ আমার মা ও বোন একই সময়ে গর্ভবতী ছিল। কয়েক দশক পরে আমার সেই বোনটিও চলে গেলেন, এমনকি আমার দুই মাসের বড় বোনের মেয়েটিও নাই হয়ে গেল। তেমনি বড় ভাই এবং বৌদিও কবেই বিদায় নিয়েছে। মেজ ভাই ও মেজ বোনও কেমন করে হারিয়ে গেল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বিধবা মা ২৪টা ঘণ্টা হেঁটে দেহটাকে নিয়ে কোনভাবে আমার তিন বছরের বড় ভাইয়ের সঙ্গে একদিন জলপাইগুড়ি এসে হাজির। সেই থেকে আমার মা যতদিন বেঁচেছিল মেজ ভাইয়ের কাছেই ছিল। আমার ভাবতে ভাল লাগছে, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন যারা হারিয়ে গেছে তাদের সবারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শুধু আমার বোনের মেয়েটি একটু তাড়াতাড়িই চলে গেল। ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা- সবকিছুই ওকে কাবু করে ফেলেছিল। ষাট দশকের শেষে দৈনিক পত্রিকায় আমার প্রথম গল্পটি, গল্পকার হিসেবে তার নাম দিয়েই মহিলা বিভাগে ছেপেছিলাম। একমাত্র মা ছাড়া আমার টিনএজ বয়সটা কেটেছে মেয়ে মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া। মায়ের সঙ্গে ঘুমুতে ঘুমুতে কখন যে বড় হয়ে উঠেছি বুঝতেই পারিনি। আমার ধারণা, আমি হাজারের বেশি দিবস মায়ের দুধ খেয়েছিলাম। মা-বাবার জীবনের বদৌলতে আমি এখনও তাই টেকসই আছি। আমি এখনও একটানা গান শুনি, সিনেমা দেখি, লেখালেখি করি, সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাতে ভুলি না, এমনকি আলাপ জমাতেও বিলম্ব করি না। কয়েক মিনিট হেঁটে একটা মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যাই। সারাক্ষণ হাসিমুখে থাকতে চেষ্টা করি। তাই তো চারপাশে হাসিমুখ দেখতে পাই। আর তাই লিখি ‘দি পাওয়ার অব স্মাইল’ অথবা ‘হাসির ক্ষমতা’ (The Potpourri of Writings- A Third Eye দ্রষ্টব্য)। রং-বেরং নিয়েই তো আমরা মানুষ। রংধনু দেখতে কার না ভাললাগে? অবাক হলেও সত্যি, সাদা, কালো, বাদামি, হলুদ, চামড়ার রং যাই হোক না কেন রক্তের রংটা কিন্তু এক এবং একমাত্র লাল। অথচ আমরা মানুষ নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদের দেয়াল তৈরি করে ফেলি। মানুষের জীবন তো পদ্মপাতায় একবিন্দু জল বৈ তো আর কিছু নয়, অথৈ জলে মিশে যাওয়ার শুধু অপেক্ষা মাত্র। শুদ্ধ মানুষ সবাই হতে পারে না। গৌতম বুদ্ধ একজনই ছিলেন। তবে পৃথিবীজুড়ে অশুদ্ধ মানুষের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। সেই স্বল্পসংখ্যক অশুদ্ধ মানুষ পৃথিবীটাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। তা পারিবারিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক হোক। কার্ল মার্ক্সের পর চেগুয়েভারার দিন কবেই গত হয়েছে। মাও সেতুংও আর নেই। এখনকার সময় হলো ফেসবুকের। আপনি হয়ত ৪টি সুন্দরী মহিলার সঙ্গে একমাত্র পুরুষ হিসেবে কথা বলছেন। দেখবেন সবার হাতেই একটি মুঠোফোন। আপনি যতই হ্যান্ডসাম হোন কোন ফায়দা নেই। যদি না আপনি নিজে ফেসবুকে নেশাগ্রস্ত কিংবা ফেসবুক সম্পর্কে অজানা তথ্য দিতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের একটি টেলিভিশনে গানের প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই প্রতি সপ্তাহে দেখে থাকেন। অবশ্যই আমরা সতেরো কোটি বাঙালী নোবেলের গান শুনে গর্বিত হই। একজন ইন্ডিভিজুয়েল কিভাবে বাংলাদেশকে বিখ্যাত করে তুলছে তার প্রমাণ নোবেল। ধুতি পরে কিংবা স্বদেশী টুপি পরে গান গেয়ে পুরস্কার হিসেবে সরস্বতীর মূর্তি হাতে নিতে পিছপা হয়নি। আবার কাওয়ালি এবং আল্লার নামে গানও গেয়েছে। আমার বিশ্বাস, অনেক দূর যাবে নোবেল। ঠিক তেমনি কৌশিক হোসেন তাপস গান-বাংলা চ্যানেল চালিয়ে সারা বিশ্বকে মাতিয়ে রাখছে। আমাদের এখন সময় এসেছে নিজেদের উৎকর্ষতা বাড়ানো। রাষ্ট্রের কর্ণধার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে তুলেছেন। আমার ভাবতে ভাল লাগছে, এমনি একটি ফেব্রুয়ারি বই মেলার সময় বাংলা একাডেমির সামনে মুখোমুখি শেখ হাসিনার সঙ্গে। রিক্সা থেকে নেমেই আমাদের মেয়েটিকে আদর করছিলেন। অন্ততপক্ষে দুই মিনিট আমাদের কথা হয়েছিল। তখন তিনি বিরোধী দলে ছিলেন। অবাক হওয়ার কথা নয়, সেই শেখ হাসিনা এখন একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। আমাদের এখন প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে সাফল্য বয়ে আনা। সমাজ গঠনে, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, কৃষি, ভলান্টিয়ারিং মনোবৃত্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ, সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের প্রয়োজন মাশরাফির মতো মানুষ। রাজনীতিতে এসে আড়াই লাখ ভোটের ব্যবধানে তো জিতবেই। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন সজ্জন ব্যক্তিই দরকার। তবে তাকে শিখতে হবে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। ক্রিকেটের মতোই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য। তবে বিরোধীপক্ষের বুদ্ধিজীবীসহ সবারই কিছু না কিছু অবদান আছে। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা, তরুণ, যুবক-যুবতীরা বয়সের ভারে এখন ক্রমশ নুয়ে পড়ছে। সেসব সংস্কৃতিবান কর্মী, শিক্ষক, শিল্পী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী যে দলেই থাকুক না কেন সবাইকে সমান দৃষ্টিতেই দেখা উচিত। তবে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে যারাই জড়িত তাদের ছাড় দেয়া যাবে না। একজন জামায়াতী পরিবারের নতুন প্রজন্ম আরও শুদ্ধ হয়ে ভাল মানুষ হতে পারে। জন্মের জন্য নতুন প্রজন্ম অবশ্যই দায়ী নয়, কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করবে তাদের ভবিষ্যত। অনেকটা বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকছি বলে নই, রীতিমতো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে কলাম লিখি। তবে আমি কট্টরপন্থী সমালোচক নই, তবু আমার স্ত্রী-মেয়েরা ‘কড়া কথা’ না লিখতে বলে। কেননা সবার পকেটেই গান থাকতে পারে আর আমি পুরোপুরি গানের বিরুদ্ধে। না আমি খাশোগী হতে চাই না, যদিও খাশোগীকে নিয়েও লিখেছি, ‘Bedouin culture in the 21st century.’। প্রায় ৬টি বছর পর আমাদের মেজ মেয়ের এন্গেজমেন্টের জন্য একটানা ২৬ ঘণ্টা ধরে পরপর ফ্লাইট নিয়ে দিল্লী হয়ে লক্ষেèৗ গিয়েছিলাম। এই বয়সে এই ধরনের ভ্রমণ উপভোগ্য নয়। তবে দিল্লীতে থেমে প্রায় ৪০টা বছর পর আমার বন্ধু প্রিয়র বাসায় উঠলাম। প্রিয়, অনুপদা এবং আমি ১৯৮০ সালে কানাডার সাসকাচেয়ানে একাডেমিক কাজে জড়িত ছিলাম। আমাদের তিন বন্ধু মিলে একটা চমৎকার সময় কাটালাম দিল্লীতে। যৌবনের বন্ধু চিরদিন অমলিন। দিল্লীতে প্রিয়র একমাত্র ছেলে কোস্তভের সঙ্গে পরিচয়। এই প্রজন্মের এমন ক্রিয়েটিভ, মিশুক, ইন্টিলিজেন্ট ছেলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এসব সৃষ্টিশীল ছেলেমেয়েই ভবিষ্যত পৃথিবীটাকে গড়ে তুলবে। কোস্তভ বলল, আঙ্কেল, এই বইটি পড়েছ? আমি বললাম, নামটা শুনেছিলাম; কিন্তু পড়া হয়নি। ক’দিনের মধ্যে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম, ইউভ্যাল নোয়া হারারি রচিত ‘Sapien: A brief history of humankind’। এক্সট্রা-অর্ডিনারি বই। একজন বিজ্ঞানমনস্ক অক্সফোর্ডে পড়া ইতিহাসবিদ কেমন হটকেক তৈরি করে ফেললেন। ৩টি ভলিউম তিনি লিখেছেন হিব্রু ভাষায়। ওগুলো ভাষান্তর করা হয়েছে। ফেরার পথে দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে তৃতীয় ভলিউম ‘21 Lessons for the 21st Century’ কিনে আনলাম। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন একজন ইহুদী ছিলেন, আর হারারিও একজন ইহুদী ইতিহাসবিদ। ভদ্রলোকের কথা ‘I encourage all of us, whatever our beliefs, to question the basic narratives of our world to connect past developments with present concerns, and not to be afraid of controversial issues.’ ভারতে থাকাকালীন বাংলাদেশের নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত ছিলাম ফলাফল সম্পর্কে। তবে এমন ল্যান্ডস্লাইড ফলাফল হবে সেটা অবশ্য ভাবিনি। তবে এখন ভাবছি, একটা টেররিস্ট দল এমনভাবেই উৎখাত হয়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেমনটি হয়েছে আইএসআইএস টেররিস্ট গ্রুপটি। বিশ্বজুড়ে টেররিস্টদের কেউ আর মদদ দেবে না। এবারের নির্বাচনেই প্রথমত সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হয়নি। নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছে। তেমন একটা খুনোখুনি হয়নি। স্বল্পসংখ্যক মুখের ভাষ্যমতে নির্বাচনে শুধুই কারচুপি হয়েছে। অথচ এই আধুনিক টেকনোলজি, মুঠোফোন, তৃতীয় নয়না সাংবাদিক, ডজন ডজন টিভি চ্যানেল থাকার পরও তেমন কোন প্রমাণ দিতে পারেনি কেউ। একবিংশ শতাব্দীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো টেররিস্ট ফ্রি দেশ। একমাত্র মানবিক দলগুলোই সাধারণ মানুষের সাপোর্ট পাবে। আর কয় বছর পর বাংলাদেশের মানুষ ভুলেই যাবে বিএনপি বলে একটা পার্টি ছিল। ঠিক যেমন কমিউনিস্ট পার্টি বলে বাংলাদেশে কিছু আছে নাকি? আমার মনে হয় মিডিয়াই জিইয়ে রেখেছে বিএনপি নামটি। অচিরেই ইতিহাসে হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ থাকবে এবং তা বাড়তেই থাকবে। শঙ্কাটা ওইখানেই। মানুষ হয়ত উপচে পড়বে একদিন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যেমন বাংলাদেশে বিপদ বয়ে আনতে পারে, ঠিক তেমনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আসতে পারে। আগামী ৫টি বছর এই সরকারের জন্য অতীব সহজ যেমন, আবার অন্যদিকে কঠিন সময়ও বটে। কঠিন সময় এজন্য বলছি, বঙ্গবন্ধুর নাম থাকবে কী আরও শতবর্ষ পরে? অথবা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, সফল এবং তুখোড় রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা কতটা দশক বেঁচে থাকবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে? আশা করছি নতুন প্রজন্ম ন্যাচারেল ওয়েতেই বুঝে নেবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী [email protected]
×