ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

রোবোটের আসল কথা

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রোবোটের আসল কথা

২০১৫ সালে নিগেল রিচার্ডস ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ স্ক্র্যাবল ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করেন। ব্যাপারটা বিশেষভাবে স্মরণীয় ছিল এই জন্য যে, রিচার্ডস নিউজিল্যান্ডবাসী। ফরাসী ভাষা জানেন না। তিনি যে কাজটা করেছিলেন তা হলো ফরাসী ক্র্যাবল ডিকশোনারির ৩ লাখ ৮৬ হাজার শব্দের পুরোটাই তিনি মুখস্থ করে নিয়েছিলেন মাত্র ৯ সপ্তাহের মধ্যে। রিচার্ডসের চমক লাগানো কাজটা এক প্রয়োজনীয় রূপক এই দিক দিয়ে যে, সত্যিকারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করে এ থেকে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। শিরোপা জেতার জন্য রিচার্ডস যেমন শব্দের বিশাল ভা-ার মুখস্থ করে ফেলেছিলেন তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বা ডিপ লার্নিং একটি নির্দিষ্ট ডোমেইন বা ক্ষেত্র থেকে বিপুল পরিমাণ ড্যাটা নিয়ে থাকে এবং সেই ড্যাটা থেকে আপনা আপনি শিক্ষা গ্রহণ করে সেই ডোমেইনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা নিয়ে থাকে। অন্যদিকে ডিপ লার্নিং মানুষের দেয়া লক্ষ্যগুলোকে সীমাহীন স্মৃতি ও অতিমানবীয় নির্ভুলতার মাধ্যমে আপনা-আপনি সর্বোত্তম উপায়ে অর্জন করতে পারে। পরিসরে সীমিত হলেও ডিপ লার্নিংকে প্রত্যেকেই কাজে লাগাতে পারে এবং এটি নির্দিষ্ট ডোমেইনের মধ্যে শক্তিশালী। এটা এ্যামাজনকে সুপারিশনামা থেকে যথাসাধ্য মুনাফা আদায়ে সাহায্য করতে পারে, কিংবা ফেসবুককে তার এ্যাপে ব্যবহারকারীর ব্যয়িত সময় যথাসাধ্য বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। তেমনি এটা ব্যাংকগুলোকে ঋণ খেলাপীর হার যথাসাধ্য কমিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে। কিংবা এর সাহায্যে এয়ারপোর্ট ক্যামেরায় ধরা পড়তে পারে কোন সন্ত্রাসবাদী বিমানে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে কি-না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনাময় প্রয়োগগুলো অতিমাত্রায় শিহরণমূলক। স্বয়ংক্রিয় যানের কথাই ধরা যাক। এতে নাটকীয়ভাবে খরচ কমবে এবং নিরাপত্তা ও দক্ষতা বাড়বে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান অনেক চ্যালেঞ্জও বয়ে আনে। তাই এই নবাগত প্রযুক্তি বিপ্লবের সত্যিকারের ঝুঁকি এবং এই বিষয়টিকে ঘিরে মাঝে মাঝে যে ভুুল বোঝাবুঝি ও বাহুল্য প্রচার দেখা দেয় তার মধ্যে প্রকৃত ব্যাপারটা নির্ণয়ের পেছনে সময় ব্যয় করার প্রয়োজন আছে। প্রথমেই চাকরি হারানোর বা কর্মচ্যুতির কথা ধরা যাক। রুটিন কতগুলো কাজে এবং সেই কাজ যদি বিপুল ড্যাটা সংবলিত একটি নির্দিষ্ট ডোমেইনের হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর সেটা পারে বলেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আগামী ১৫ বছর কি অনুরূপ সময়ের মধ্যে লাখ লাখ উঁচু পর্যায়ের ও নিচু পর্যায়ের চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত করতে পারার মতো ক্ষমতা রাখে। তবে সব চাকরি বা কাজ যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল করে নিতে পারবে তা নয়। বস্তুতপক্ষে চার ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি নেই। প্রথমত রয়েছে সৃজনশীল কাজ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা অর্জনের লক্ষ্য দিতে হয়। বিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক ও চিত্রশিল্পীরা যেমন আবিষ্কার ও সৃষ্টি করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা পারে না। দ্বিতীয়ত. নির্বাহী কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদদের জটিল স্ট্র্যাটেজিক কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একক ডোমেইন ও বিশাল ড্যাটার ভা-ারের আওতার বাইরে। তারপর আছে এখনও পর্যন্ত অজানা এমন কিছু কাজ যা হয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা করা সম্ভব হবে না। চতুর্থ ধরনের কাজগুলো আরও বড় আকারের সেখানে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, দয়া, মমতা এগুলো দরকার যেমন শিক্ষক, বাচ্চাদের দেখাশোনা করার আয়া, ডাক্তার-নার্স ইতাদি। মায়া, মমতা, সহমর্মিতার এই কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের ওই গুণাবলী নেই। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি ওগুলোকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেও বা কেউ চাইবে না একটা চ্যাটবট বলবে আপনার ক্যান্সার হয়েছে। কিংবা চাইবে না একটা রোবোট বেবি সিটারের কাজ করুক। কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগেও কাজ থাকবে। মূল কথাটা তাহলে হলো শ্রমশক্তিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন করে প্রশিক্ষিত করতে হবে। এটা শুধু সরকারের দায়িত্ব হলে চলবে না, কর্পোরেশনগুলোকে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা ভোগকারী অতি ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরি খেয়ে নেয়া ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমাজে অসাম্য বহুগুণ বাড়িয়ে তোলার যথেষ্ট সক্ষমতা রাখে। যেমন অতি-ধনী ও চাকরি হারানো শ্রমিকদের মধ্যে এবং দেশগুলোর মধ্যে ব্যবধান ও বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আর্থিক সুফল তুলে নিতে পারে। পক্ষান্তরে দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে এই প্রযুক্তি ব্যবহার আর্থিক দিক দিয়ে সম্ভব নয় বিধায় তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। এই প্রযুক্তি নিরাপত্তার প্রতিও গুরুতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাগুলো হ্যাকিং করার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। ভাবুন তো দেখি স্বয়ংচালিত গাড়ি হ্যাক করে সন্ত্রাসবাদীরা যদি সেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাহলে কি ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে। তাছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রাইভেসি লঙ্ঘন, অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব করা ও নানা ধরনের কারসাজি করার মতো সমস্যা আছে। এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় ইতোমধ্যে যথেষ্ট ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া গেছে। ব্যবহারকারীর প্রাইভেসি লঙ্ঘন করে পক্ষপাতিত্ব ও বিভাজন বাড়িয়ে এ্যাপগুলোর ব্যবহার ও মুনাফা সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যেতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর প্রলোভন ফেসবুক কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইউটোপীয় ও অন্যরা এমন হুঁশিয়ারি দিতে পছন্দ করে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে অপ্রয়োজনীয় ও বাতিল করে তুলছে। তারা বলে যে- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমাদের আত্তীকরণ ঘটে গিয়ে আমরা মানব ক্রাইযোগে বিবর্তিত হব। এমনও হুঁশিয়ারি আছে যে, বিশ্বে রোবোট প্রভুরা আধিপত্য করবে। কিন্তু কেউই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে প্রকৃত বুদ্ধিটা কে কিভাবে জোগাচ্ছে তা কিন্তু কেউ বলছে না। সাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সেই যুগ যে যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেয়েও ভালভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলো করতে সক্ষম হবে তা এখনও বহু দূরে রয়েছে। সাধারণ কত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রয়োজন অগ্রসর বা উন্নত সক্ষমতা যেমন যুক্তি, ধারণাত্মক শিক্ষা, সাধারণ জ্ঞান ও বোধ, পরিকল্পনা, সৃজনশীলতা এমনকি আত্মসচেতনতা ও আবেগ যার সবই আমাদের বৈজ্ঞানিক আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। এই সাধারণ ক্ষমতাগুলো আয়ও করার কোন জ্ঞাত প্রকৌশলগত উপায় নেই। বড় ধরনের অভাবনীয় কোন সাফল্যও সহজে বা তাড়াতাড়ি ঘটবে বলে মনে হয় না। সেই নিগেল রিচার্ডসের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। স্ক্র্যাবল ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ফ্রাঙ্কোফোনকে পরাজিত করেছিলেন। ড্যাটা বা উপাত্ত মুখস্থ করার ও শব্দাবলীর বিন্যাস থেকে যথাযথ শব্দটি বেছে নেয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা তার ছিল। কিন্তু তাকে যদি গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের কোন উপন্যাস মূল্যায়ন করতে বলা হয় তাহলে তিনি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়বেন। কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখন মানুষের ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়ে যাবে এমন কথা জিজ্ঞাস করা আর রিচার্ডস কখন ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্য পুরস্কার ফ্রিক্স গনকোর্ট জয় করবেন সে প্রশ্ন করা একই রকম ব্যাপার। বিষয়টা যে একেবারেই অসম্ভব তা নয়- তবে না হওয়ার সম্ভাবনাই অত্যন্ত বেশি। মানব মস্তিষ্ক মানবজাতির জানা সবচেয়ে জটিল সত্তা। মাতৃজঠর থেকে ধীরে ধীরে এটি বিকশিত হয়। জন্মের পর মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। মস্তিষ্কের কারণে আমরা দিনরাত্রি পার্থক্য বুঝি, গরম-ঠাণ্ডা, শব্দ ও নীরবতা এবং আর সব কিছু বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আনন্দ, বেদনা, ভয়-ভীতি, দুঃখ ও অন্যান্য অনুভূতি। মস্তিষ্ক এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। এর কোন অফ সুইচ বা রিসেট বাটন নেই। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে একটা এলগোরিদম যা যৌক্তিক বাইনারি ব্যবস্থার ভিত্তিতে চলে। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামিং এমনভাবে করতে পারি, যাতে তা মানুষের চাইতে দ্রুত গতিতে ও আরও ভালভাবে কাজ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা বিশ্ব দাতা ও ‘গো’ চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ, এরা মানুষের চেয়ে দ্রুত বিভিন্ন অপশন হিসাব করতে সক্ষম। সন্দেহ নেই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও অনেক উৎকর্ষ ঘটানো হবে। তবে তাই বলে মানব মস্তিষ্কের চেয়ে শ্রেয়তর কখনই হতে পারবে না। মানব বুদ্ধিমত্তার নানা রূপ আছে। আজ কোন কম্পিউটার এতটা চালাক নয় যে, একটা রোবোটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে- যে কাজটা করতে পারবে একজন গৃহপরিচারক। কোন কম্পিউটার একজন শিল্পীর বা সাহিত্যিকের কিংবা বৈজ্ঞানিকের চিন্তার প্রক্রিয়াগুলো নকল করতে পারে না। কোন কম্পিউটার সত্যি সত্যি বোঝানোর অর্থে বলতে পারে না ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’ কোন কম্পিউটারের তার নিজস্ব চেতনার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিজের বিশ্বাস থাকতে পারে না এবং বস্তুতপক্ষে নেইও। সূত্র : টাইম ও অন্যান্য
×