ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নার্গিস জাহান বানু

একজন রফিকুল ইসলাম বার বার আসে না

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

একজন রফিকুল ইসলাম বার বার আসে না

গত ২০ নবেম্বর ২০১৮ ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনন্য রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের পঞ্চম প্রয়াণ দিবস। আমার জানা মতে, দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, বাংলাদেশ চ্যাপটার তাঁর এই প্রয়াণ দিবস অনুষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার ১৯তম বর্ষপূর্তির আয়োজন করেছিল। আর অন্য কারও বা কোন দিকে কোন আয়োজন আমার চোখে পড়েনি। না সরকার, না কোন ব্যক্তি বা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে। হয়ত বা এ জন্যই ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মায় না।’ কথাটি সত্য মানতে হয়, কারণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকথার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম তো আর প্রতিদিন জন্মায় না। বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার হয়ে উঠবার পূর্বপাটে তাঁর প্রাথমিক জীবন পরিচয়ের খানিকটা উল্লেখ করছি। মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ১৯৫৩ সালে ১৬ জুলাই কুমিল্লা শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলভী গনি ছিলেন একজন আইনজীবী। মা বেগম করিমুন্নেছা ছিলেন গৃহিণী। দশ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। ছাত্রজীবনে তিনি প্রত্যক্ষ ছাত্র রাজনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৭০-১৯৭১ শিক্ষাবর্ষে। রফিকুল ইসলাম ১৯৭১ সালে মুক্তি বাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতের মিলিটারি একাডেমি দেরাদুনে গেরিলা প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সাফু পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে আরও দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শাহাদাত বরণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮১ সালে জার্মানিতে প্রবাস জীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি জার্মানদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সালে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে হেড অফিসে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি স্থিত হন কানাডার ভ্যানকুভার শহরে, ১৯৯৫ সালে। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়নের কাজ তিনি শুরু করেন দেশে থেকেই। বাংলাদেশে থাকাকালীন ১৯৮৭ সালের দিকে তার মাথায় এলো আমাদের ভাষা শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেয়ার জন্য জাতিসংঘে আবেদন করার বিষয়টি, যাতে বিশে^র সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে সম্মান প্রদর্শন ও যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। যাতে বিশে^র সকল জাতির মাতৃভাষা, সংস্কৃতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা ও অবাধ মাতৃভাষা চর্চা ও এর বিকাশ এবং যথাযথ মর্যাদা দেয়া যায়। সেই ধারাবাহিকতায় বিশে^ একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার জন্য ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারিতে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব মি. কফি আনানকে চিঠি দেন। চিঠির উত্তরে জাতিসংঘ থেকে ২৩ জানুয়ারি ১৯৯৮ বাংলাদেশের সরকারের যথাযথ কর্তপক্ষের মাধ্যমে প্রস্তাবটি পাঠাতে পরামর্শ দেন। ওই সময় তিনি তাঁর বন্ধু আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে ভ্যানকুভার বসবাসকারী ৭টি ভাষার ১০ জনকে নিয়ে গঠন করেন ‘দি মাদার ল্যাাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড’ সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় দুই বছরের নিরলস চেষ্টায় ইউনেস্কো মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর। এই অভাবনীয় অর্জনের প্রধান রূপকার রফিকুল ইসলাম, সহযোগী বন্ধু আবদুস সালাম এবং তার পরে আমরা সকল বাঙালী। রফিক ভাই আমাদের লোক, তিনি প্রশিকার কর্মকালীন সময়ের আমার এক প্রাণোচ্ছল টগবগে তরুণ সহকর্মী। এই কথা মনে করে আমি গৌরব বোধ করি। এই মানুষটিকে ভুলতে বসেছি আমরা? এই রফিকুল ইসলাম একদা মানুষের রাজনৈতিক হীনমন্যতায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন। এ জাতি যখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করত তখন তিনি বঙ্গবন্ধু ‘জাতির পিতা’ এ নিয়ে গণমানুষের কাছ থেকে স্বাক্ষর গ্রহণ শুরু করেন ১৯৯৩ সালে। এ জন্য তিনি একটি মোটা খাতা খরিদ করে প্রথম স্বাক্ষর গ্রহণ করেন কবি বেগম সুফিয়া কামালের। তাঁর এই স্বাক্ষর সংগৃহীত খাতাটি ‘দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স আব দি ওয়ার্ল্ড’, ভ্যানকুভারে সুরক্ষিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে অপার শ্রদ্ধা নিবেদনের দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন তাঁর এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে- প্রিয় মেহরাব, যে জাতির মূল স্তম্ভ ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো ন্যায়ের পক্ষে, ঘটনাক্রমে সে জাতি হঠাৎ করে নেতাকে হারিয়ে সাময়িক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লে আমার মনে হয় খুব সহসাই আবার মূল স্রোতে ফেরত আসবে, সোজা হয়ে দাঁড়াবে এবং ন্যায়ের পক্ষে পতাকা ওড়াবেই। সে পতাকার উজ্জ্বল রং দেখার প্রবল ইচ্ছা ব্যক্ত কর। শুভেচ্ছান্তে তোরই রফিক তারিখ জুলাই ৯, ২০০১ এই হলেন রফিক। মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের জন্য তিনি চিন্তা-ভাবনা করেন। শুধু চিন্তা করেই ক্ষান্ত হননি শুরু হয়ে গেল কাজ, সেটাও ১৯৯৩ সালেই। নিত্য শুভার্র্থ বন্ধু মেহরাবকে বাহিনীর কমান্ডার এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করালেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন দলমত নির্বিশেষে সকল বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে, সে আদর্শে গঠিত হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ।’ মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কবর চিহ্নিত করে কবর পাকা করা এবং নামফলক লাগানো ও শহীদ পরিবারের উন্নয়নকল্পে কাজ করা এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, সৈয়দ রেজাউর রহমানই সংগঠনটি পরিচালনা করছেন। তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল নানাবিধ মানবিক গুণাবলী এবং নতুন নতুন জনহিতকর কর্মকা-ে নিজেকে সর্বদাই ব্যস্ত রাখতেন। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া, পঙ্গু হয়ে যাওয়া ব্যক্তির অসহায় পরিবার পরিজনের করুণ পরিণতি তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। স্থির থাকতে পারেননি তিনি। বাল্যবন্ধু কবির মেহ্রাবের উৎসাহে তৎকালীন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে ‘নিয়ম মেনে চলি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। মা-বাবার নামে গঠন করেন করিমুন্নেছা গনি, শিক্ষা ফাউন্ডেশন। নিজের পৈত্রিক সম্পত্তির লভ্যাংশ এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের আর্থিক সহযোগিতায় ব্যয় করতেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য পরিষেবার মান বৃদ্ধি, দক্ষ ও অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ‘চিকিৎসা সেবা সোসাইটি’ গঠন করেন। গঠন করেন ‘ঘুষ ও অন্যায় উপার্জনমুক্ত বাংলাদেশ ফোরাম।’ এই সংগঠনের সব সদস্যদের স্বাক্ষরসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে পাঠান। এই পত্র প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করে পত্র পাঠান যে, এই প্রস্তাবের কার্যকরী পদক্ষেপ দেশ ও জাতিকে এ অন্ধকারের অভিশাপ থেকে আলোকিত পথ দেখাবে। যুদ্ধকালীন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের নিত্য শুভার্থী এই দেশপ্রেমিক ২০১১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ছোটবোন রীনার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে কর্মমুখর জীবনযাপন করছিলেন। থেমে থাকেননি এক মুহূর্তের জন্যও। প্রবাসে জীবন-জীবিকা, পরিবারের প্রতি পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন এ সকল কর্তব্য করেও এক মিনিট সময়ও তিনি নষ্ট করেননি। সব সময় ব্যস্ত থাকতেন দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায়। ক্যান্সার আক্রান্ত এই অপরিসীম প্রাণশক্তির অধিকারী মানুষটি সর্বশেষ উদ্যোগ ছিল ২০১২ সালে বাংলা ভাষা সহজীকরণ। এই প্রেক্ষিতে ‘কারা আমার মায়ের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ এই শিরোনাম ভ্যানকুভার থেকে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন ভূঁইয়াকে একটি প্রস্তাব পাঠান যাতে বাংলাদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সহজে পড়তে এবং লিখতে পারে। স্বপ্নের কারিগর প্রবাস থেকে দেশের আপামর জনসাধারণের মঙ্গল স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের দেশে চলে যান ২০১৩ সালের ২০ নবেম্বর। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। ১৪ নবেম্বর ‘স্বরব্যঞ্জন’ নামে একটি সংগঠন রফিক ভাইকে ড.আনিসুজ্জামান স্যারের সহি করা একটি সার্টিফিকেট ও সম্মাননা হাসপাতালে প্রদান করেন। অস্স্থু শরীরে মধুর হাসি হেসে ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিলেন ‘আমি স্যারের দেয়া সার্টিফিকেট পেয়েছি- স্যারকে ধন্যবাদ।’ এমনই মন ও মানসিকতার ব্যক্তি ছিলেন রফিক ভাই। সঙ্গত কারণেই বলতে ইচ্ছে করে- একজন এমন দেশপ্রেমিক রফিকুল ইসলাম বাঙালী জাতিতে কেন বারে বারে আসেন না। লেখক : নারী নেত্রী ও উন্নয়ন কর্মী
×