ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকি দিতে ছয় বছরে মূসক আরোপযোগ্য ৭২ কোটি টাকার বিক্রির তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ায় ফাঁকি দেয়া ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ভ্যাট ও সুদসহ মোট ১৮ কোটি টাকা দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের অধীনস্থ আনোয়ার গ্যালভানাইজিং দীর্ঘদিন ধরেই বিক্রির তথ্য লুুকিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের মে মাসে আনোয়ার গ্রুপের অফিসে অকস্মাৎ অভিযান চালায় মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের চারটি দল। অভিযানে কোম্পানিটির পাঁচ বছরের সিএ রিপোর্ট (নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী), সেল অর্ডার ও পণ্যের মূল্য তালিকা জব্দ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ওই সব তথ্যের সঙ্গে এনবিআরে কোম্পানির প্রদর্শিত রিটার্নের তথ্য মিলিয়ে বড় ধরনের গরমিল পায় প্রিভেন্টিভ টিম। এ সময়ে কোম্পানিটি ৭২ কোটি টাকার বেশি মূসক আরোপযোগ্য বিক্রির তথ্য লুকিয়েছে, যেখান থেকে ভ্যাট বাবদ সরকারের পাওনা ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে উঠে আসা এ অনিয়মের বিষয়ে কোম্পানিকে চিঠি দেয়া হলেও তার জবাব আসেনি। পরে প্রাথমিক প্রমাণ সাপেক্ষে সম্প্রতি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনাল ১৯৯১ সালের মূসক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধানের পর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মূসক আইন, ১৯৯১-এর ৫৫(১) ধারা বলে ১০ কোটি ৮০ লাখ ও একই আইনের ৩৭(৩) ধারা অনুযায়ী ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা দাবি করে চিঠি দেয়া হয়। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন জবাব না পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে মামলা করা হয়েছে। এখন উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। মামলার বিবরণ অনুযায়ী, আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এনবিআরে প্রদর্শিত বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সিএ রিপোর্টের তথ্যের মিল-অমিল পর্যালোচনা করা হয়। এতে কোম্পানির গোপন করা বিক্রয়মূল্য ও পরিহারকৃত মূসকের এসব প্রমাণ পাওয়া যায়। হিসাব অনুযায়ী কোম্পানিটি পাঁচ বছরে মূসকযোগ্য ৭৯ কোটি ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করলেও এনবিআরে প্রদর্শন করেছে মাত্র ৬ কোটি ৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ভ্যাট ফাঁকি দিতে এ সময়ের মধ্যে মূসকযোগ্য ৭২ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকার বিক্রয় তথ্য লুকিয়েছে। এতে আইন অনুযায়ী বিক্রির সব ক্ষেত্রে মূসক-১ চালানপত্র ইস্যু করার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পরিপালন না করে কোম্পানিটি মূসক আইন, ১৯৯১-এর ৩, ৬, ৩১ ও ৩২ ধারা লঙ্ঘন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির এরূপ কর্মকাণ্ড মূসক আইন, ১৯৯১-এর ৩৭ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। বর্ণিত অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে ৫৫(১) ধারা অনুযায়ী ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার মূসক ও ধারা ৩৭(৩) অনুযায়ী এর অনাদায়ী সুদ বাবদ আরও ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা আদায়যোগ্য। এদিকে এনবিআরের পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে দাবিনামা পাঠানোর কথা বলা হলেও তা নিয়ে কোন মন্তব্য করছেন না আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে এনবিআর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলেও দাবি করছেন তারা। কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) গোপাল চন্দ্র ঘোষ বলেন, ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগের বিষয়টি আমরা জানি না। এ বিষয়ে এনবিআরের কোন চিঠি আমরা এখনও পাইনি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে কথা না বলে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হচ্ছে না। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আনোয়ার গ্যালভানাইজিং সর্বশেষ ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ৩৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। বছরের ব্যবধানে তাদের বিক্রি বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সমাপ্ত বছরে কোম্পানির নিট মুনাফা হয় ১ কোটি ৭৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বার্ষিক শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ২৪ পয়সা। বছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। আগের বছর ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছিল তারা। এদিকে চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের ইপিএস হয়েছে ৪০ পয়সা, আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ৬৫ পয়সা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে ইপিএস হয়েছে ১১ পয়সা, আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ৪১ পয়সা। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৯ টাকা ৭৪ পয়সা। আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের অনুমোদিত মূলধন ২০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ১৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। মোট শেয়ার ১ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার, যার মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১৬ দশমিক ৬৯ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে আছে বাকি ৪৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ শেয়ার।
×